শিল্পে উৎপাদন কমছে, বাড়ছে ব্যয়

ডিজেলচালিত জেনারেটর চালিয়েও উৎপাদন পুরোপুরি সচল রাখা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড গরম ও লোডশেডিংয়ে নেতিবাচক প্রভাব শিল্পে।

বিদ্যুৎ না থাকায় কাজ বন্ধ। অলস সময় পার করছেন একটি নিট পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা। বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। সোমবার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা বিসিক শিল্পাঞ্চলের অহনা নিট কম্পোজিট মিলেছবি: দিনার মাহমুদ

গাজীপুরের পুবাইল ও নরসিংদী বিসিকে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় হস্তশিল্প রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের দুটি কারখানা রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় কারখানা দুটিতে ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন চালাতে হচ্ছে দিনের একটি বড় সময়ে। আবার সব যন্ত্র জেনারেটরে চালানো যায় না। তাই উৎপাদন ঠিক রাখতে কর্মীদের দিয়ে তিন-চার ঘণ্টা ওভারটাইম করানো হচ্ছে। তাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে ১০-১৫ শতাংশ।

ক্রিয়েশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রোববার (পরশু) পুবাইলের কারখানায় সাত-আটবার লোডশেডিং হয়েছে। আর নরসংদীর কারখানায় পাঁচ-ছয়বার। অবস্থা এমন যে আমরা বসে থাকি, কখন বিদ্যুৎ আসবে। সামনের দিনে বিদ্যুতের অবস্থার আরও অবনতি হলে লোকসান ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তিনি বলেন, বর্তমানে এলাকা ভাগ করে কোন এলাকায় কখন বিদ্যুৎ থাকবে না, সেটি পরিষ্কার করে জানানো প্রয়োজন।

ক্রিয়েশনের মতো দেশের অধিকাংশ শিল্পকারখানা বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে ভুগছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় জেনারেটর চালিয়েও উৎপাদন পুরোপুরি সচল রাখা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড গরমে শ্রমিকেরা অস্থির হয়ে পড়ছেন। তাতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পরিস্থিতির শিগগিরই উন্নতি না হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটিতে বিসিক শিল্পনগরীর অহনা নিটিং কম্পোজিটে দৈনিক ৩৮ হাজার টি-শার্ট উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। গতকাল সোমবার প্রথম আলোর নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি দুইটার দিকে কারখানাটিতে গিয়ে দেখেন, বিদ্যুৎ নেই। তখন মধ্যাহ্নভোজের বিরতি চলছে। বিরতির পর বেলা দুইটায় কারখানার উৎপাদন শুরু হয়। জেনারেটর দিয়ে কারখানার উৎপাদন সচল রাখা হয়। দুই ঘণ্টা পর বেলা তিনটার দিকে কারখানাটিতে বিদ্যুৎ আসে।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ছানাউল্লাহ্ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। একবার বিদ্যুৎ চলে গেলে এক থেকে দুই ঘণ্টা পর আসছে। জেনারেটর দিয়ে সুইং সেকশনের উৎপাদন চালু রাখা সম্ভব হলেও বয়লার চালানো যাচ্ছে না। ফলে ফিনিশিং সেকশনের উৎপাদন বন্ধ থাকছে। এতে রপ্তানি পণ্য প্রস্তুতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

পঞ্চবটি বিসিক শিল্পনগরীতে ২১৫টি পোশাক কারখানা, সাতটি ডাইং কারখানা এবং চার শতাধিক নিটিং (সুতা থেকে কাপড় তৈরি) কারখানা আছে। নিটিং কারখানাগুলো পুরোটাই বিদ্যুৎনির্ভর। তবে ৯৫ শতাংশ কারখানায় জেনারেটর নেই। ফলে লোডশেডিংয়ের সময় এই কারখানাগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকছে বলে জানালেন উদ্যোক্তারা।

বিসিকের ২ নম্বর সড়কের ৪ নম্বর লেনের ফেয়ার অ্যাপারেলস কারখানায় কাজ করেন ৫০০ শ্রমিক। গত রোববার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাঁচ দফায় কারখানাটিতে সাড়ে চার ঘণ্টা লোডশেডিং হয়। ৫০০ কিলোওয়াটের জেনারেটর চালাতে প্রতি ঘণ্টায় ১৮ হাজার টাকার ডিজেল লাগে।

এ প্রসঙ্গে কারখানার ব্যবস্থাপক মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুইবারে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে। আরও হবে। যতবার বিদ্যুৎ চলে যাবে, ততবার জেনারেটর চালু করে উৎপাদন স্বাভাবিক করতে আট-দশ মিনিট সময় লাগে। তিনি বলেন, জেনারেটরে লোড সংকুলান না হওয়ার কারণে নিটিং মেশিন চালানো যায় না। এ কারণে কাপড় বোনার পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে গেছে।

এদিকে গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলো বিদ্যুৎ–সংকটে পড়েছে। গাজীপুর পল্লি বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর আওতাধীন গাজীপুর সদর উপজেলা ও শ্রীপুর উপজেলার কিছু এলাকা এবং কাপাসিয়া উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ১২০ মেগাওয়াট। এখানে লোডশেডিং সর্বোচ্চ ৪৯ মেগাওয়াট। ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির-২-এর শ্রীপুর ও মাওনা আঞ্চলিক কার্যালয় আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা ১৪০ মেগাওয়াট। পাওয়া যাচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ মেগাওয়াট। এসব এলাকায় গ্রাহকেরা দিনে সাত থেকে আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না।

গাজীপুর চেম্বারের সভাপতি আনোয়ার সাদত সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যুতের চলমান সংকটে  ছোট কারখানাগুলো পথে বসার উপক্রম হয়েছে। শিল্পকারখানার উৎপাদন অনেক কমে গেছে। গাজীপুরের বড় কারখানাগুলো পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতে পারলেও ছোটরা পারছে না।’

বিদ্যুৎ–সংকটে চট্টগ্রামের ইস্পাত কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দেশের বড় ইস্পাত কারখানাগুলোর অবস্থান চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই এলাকার ইস্পাত কারখানায় দুই দিন ধরে উৎপাদন কম-বেশি ৩০ শতাংশ ব্যাহত হচ্ছে।

শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত পণ্য উৎপাদনকারী বিএসআরএম গ্রুপের আটটি কারখানা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে দুই দিন ধরে উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমেছে।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বিদ্যুৎ গ্যাস সংকটে শিল্পের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বিশেষ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম এবং প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর]