মেধাস্বত্ব পরিপালন করলে বাড়বে বিদেশি বিনিয়োগ

অ্যামচেম আয়োজিত সেমিনারে আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে সংগঠনটির নেতারা
ছবি: বিজ্ঞপ্তি

মেধাস্বত্ব আইন পরিপালনের মাধ্যমে ব্যবসা করলে তাতে অর্থনীতি বেশি উপকৃত হয়। মেধাস্বত্ব আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন বিদেশি বিনিয়োগকেও উৎসাহিত করে। কারণ, বর্তমানে বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব আইনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশ যেহেতু এখন বিদেশি বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তাই এ দেশে মেধাস্বত্ব আইনের পরিপালনে আরও জোর দিতে হবে।

বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে গঠিত সংগঠন আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ বা অ্যামচেম আয়োজিত সেমিনারে এসব মন্তব্য করেছেন আলোচকেরা। তাঁরা বলেন, পৃথিবীজুড়ে এখন ব্যবসায়ীদের বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নকল পণ্য। নকল পণ্যের কারণে ভালো পণ্যের বাজার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি এ ধরনের পণ্য মানুষের জীবনমানের জন্যও হুমকি। এ ছাড়া যেসব দেশে এ ধরনের নকল পণ্য তৈরি হয়, বিশ্বদরবারে সেই দেশের সুনামও ক্ষুণ্ন হয়।

‘মেধাস্বত্ব আইনের সুরক্ষা ও অনুশীলন এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি’ শীর্ষক এই সেমিনারে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা। রাজধানীর বনানীতে শেরাটন হোটেলে বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) সকালে আয়োজিত এ সেমিনারে মেধাস্বত্ববিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের অর্থনৈতিক ইউনিটের প্রধান জোসেফ গিবলিন। বক্তব্য দেন অ্যামচেম সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ, যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অ্যান্ড ট্রেডমার্ক কার্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের মেধাস্বত্ব নীতিবিষয়ক পরামর্শক শিল্পী ঝা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য হোসেন আহমদ, বাংলাদেশ পেটেন্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুনিম হাসান, বাংলাদেশ মেধাস্বত্ব বা আইপি ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা হামিদুল মিসবাহ প্রমুখ। সেমিনার সঞ্চালনা করেন অ্যামচেমের সহসভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল।

আমন্ত্রিত অতিথির বক্তব্যে শ্রমসচিব জাকিয়া সুলতানা বলেন, মেধাস্বত্ব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে যেমন উৎসাহিত করে, তেমনি ভোক্তার অধিকার সুরক্ষার পাশাপাশি উৎপাদকদের বাজার প্রতিযোগিতাও নিশ্চিত করে। সেই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে করে থাকে। তিনি আরও বলেন, মেধাস্বত্ব নিশ্চিত করা হলে তা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সুরক্ষা কবজ হিসেবে কাজ করবে। সরকার আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাস্তবতা বিবেচনায় সম্প্রতি পেটেন্ট আইন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন আইন ও কপিরাইট আইন করেছে। সংশোধিত এসব আইনে মেধাস্বত্বের বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধে জোসেফ গিবলিন বলেন, মেধাস্বত্বের ক্ষেত্রে নকল পণ্যের বাজার রোধ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কোনো নকল পণ্য বাজারজাত মানে একটি আসল পণ্যের বাজার হারানো। নকল পণ্যের কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই নকল পণ্য ব্যবহার রোধে তিনি জনসচেতনতা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তাঁর মতে, এ ধরনের পণ্য শুধু ব্যবসার জন্য নয়, মানুষের জীবনমানের জন্যও হুমকিস্বরূপ।

সেমিনারে আমন্ত্রিত অতিথিদের বক্তব্যের পাশাপাশি একটি প্যানেল আলোচনারও আয়োজন করা হয়। প্যানেল আলোচকেরা সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এ সময় নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক জানতে চান, তিনি প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করেন। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে অনেক সময় একই ব্র্যান্ডের নকল পোশাক তৈরি করে রপ্তানি করা হয়। পরে আমদানিকারক দেশ থেকে বলা হয় বাংলাদেশে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের নকল পোশাক তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিকার কী? আমদানিকারক দেশের কি কোনো দায় নেই? জবাবে শিল্পী ঝা বলেন, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশেই যদি ওই পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান যে ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করছে, তার বিপরীতে নিবন্ধন নেয়, তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো যাবে। বিদেশি ক্রেতা তখন জানতে পারবে কোন ব্র্যান্ডের পোশাক বাংলাদেশে কারা তৈরি করে।

প্রশ্নোত্তর পর্বে সংগীতশিল্পী ও মাইলস ব্যান্ডের সদস্য শাফিন আহমেদ বলেন, দেশে বর্তমানে যে কপিরাইট আইন আছে, সেটির আওতায় কোনো গানের নিবন্ধন নিতে গেলে সেই গানের সিডি জমা দিতে হয়। এ ছাড়া গানের নিবন্ধন নিতেও সরকারি মাশুল লাগে। এতে অনেকে নিরুৎসাহিত হন। এ সময় শাফিন আহমেদ কপিরাইট কার্যালয়ে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি পরামর্শক কমিটি গঠনের সুপারিশ করেন। শাফিন আহমেদের এ প্রশ্নের জবাবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাফরিজা শ্যামা বলেন, কপিরাইট কার্যালয়ের জন্য খুব দ্রুতই একটি পরামর্শক কমিটি বা বোর্ড গঠন করা হবে।

সেমিনারে জানানো হয়, মেধাস্বত্ব নতুন উদ্ভাবনের জন্ম দেয়, আর উদ্ভাবনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি হয়, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের মোট কর্মসংস্থানে প্রায় ২৮ শতাংশই মেধাস্বত্বনির্ভর শিল্পের অবদান। আর দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৩৮ শতাংশের বেশি আসে মেধাস্বত্বনির্ভর শিল্প খাত থেকে। তবে সেমিনারে এটাও জানানো হয়, মেধাস্বত্ব চুরির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ২২৫ থেকে ৬০০ বিলিয়ন বা ২২ হাজার ৫০০ থেকে ৬০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়।