আশা-নিরাশার দোলাচলে চকবাজারের ব্যবসায়ীরা

ঈদ সামনে রেখে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে সুগন্ধির চাহিদাও বেড়েছে পাইকারি বাজারে। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেচাবিক্রি গতবারের তুলনায় কম। সম্প্রতি রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারে
ছবি: খালেদ সরকার

রোজা শুরু হতে আর কয়েক দিন বাকি। এর মধ্যেই ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি পণ্যের বাজার পুরান ঢাকার চকবাজারে। শবে বরাতের আগে থেকেই বেচাকেনার এই মৌসুম শুরু হয় চকবাজারে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে পণ্যভেদে বেচাকেনার পরিমাণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

চকবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এ বছর বিক্রি এখনো আশানুরূপ জমেনি। এ ছাড়া ঋণপত্র খুলতে সমস্যা হওয়ায় প্রয়োজনীয় পণ্যের মজুতও কম। তবে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ জানিয়েছে, এ বছর বিক্রি গত বছরের চেয়ে ভালো।  

চকবাজারের মনিহারি পণ্যের ব্যবসায়ী হাজি মো. ইউসুফ বলেন, ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা টুকটাক শুরু হয়েছে। তবে অবস্থা ‘না ভালো, না মন্দ’। তাই রোজার শেষ পর্যন্ত বেচাকেনা কেমন হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

গত বছরের (ঈদ মৌসুম) তুলনায় এবার বেচাকেনার গতি কম। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ মনিহারি পণ্য কম কিনছেন। এ কারণে পাইকারিতে বিক্রি কম
মো. ফয়েজুদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতি

গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনের রাস্তা ধরে সামনে এগোতেই ঈদের বেচাকেনার কিছুটা আঁচ বোঝা গেল। কারণ, বছরের অন্য সময়ের চেয়ে ছুটির দিনেও ওই সড়কে মানুষ ও যানবাহনের ভিড় বেশি। ওই সড়ক ধরে চকবাজারে পৌঁছাতে প্রথমেই তামান্না ট্রেডার্সে চোখ আটকে গেল। মনিহারি পণ্য বিক্রির এই দোকানে তখন গ্রাহক ছিল সাতজন। তারা সবাই বিভিন্ন জেলার খুচরা বিক্রেতা।  

গ্রাহক সামলানোর একফাঁকে দোকানটির হিসাবরক্ষক রাফিউল ইসলাম জানান, মৌসুমের শুরু হিসেবে বেচাকেনা মোটামুটি ভালো। তবে আরও বেশি বিক্রির প্রত্যাশা ছিল তাদের। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাকিতে বেচাকেনা করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য নগদ টাকায় বিক্রিতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তাঁরা।  

চকবাজারে সারা বছর ব্যবসা-বাণিজ্য চালু থাকলেও ঈদকে কেন্দ্র করে এখানে বেচাকেনা অনেক বেড়ে যায়। বিভিন্ন প্রসাধনী, ইমিটেশন অলংকার, খেলনা ইত্যাদির প্রধান পাইকারি বাজার এটি। চকবাজার ছাড়াও আশপাশের এলাকা যেমন মৌলভীবাজার, বেগমবাজার, উর্দু রোডও বিভিন্ন ধরনের পাইকারি পণ্যের বৃহত্তম বিক্রয়কেন্দ্র।

এ এলাকার ব্যবসায়ীরা জানান, শবে বরাতের কয়েক দিন আগে থেকে চকবাজারে পণ্য বেচাকেনা শুরু হয়, যা চলে রোজা শুরুর আগপর্যন্ত। রোজার প্রথম তিন-চার দিন আবার বেচাকেনা কম থাকে। এরপর আবার পাইকারি বিক্রির ধুম পড়ে, যা চলে ২০ রোজা পর্যন্ত। এরপর ঈদ পর্যন্ত খুচরা পর্যায়ে পণ্য বিক্রি করেন চকবাজারের ব্যবসায়ীরা।

তবে এ বছর শবে বরাতের পর বেচাকেনা তেমন জমেনি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মনিহারি বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ফয়েজুদ্দিন। তিনি বলেন, গত বছরের (ঈদ মৌসুম) তুলনায় এবার বেচাকেনার গতি কম। এর পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে বলে জানান ফয়েজুদ্দিন। প্রথমত, নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ মনিহারি পণ্য কম কিনছেন।

এ কারণে পাইকারিতে বিক্রি কম। দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনীয়সংখ্যক ঋণপত্র খুলতে না পারায় পণ্যের মজুতও গতবারের তুলনায় কম। এ কারণে খুচরা ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। তৃতীয়ত, দেশে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তি। তাই মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছেন। এ জন্য আশানুরূপ বিক্রি নেই।

চকবাজারের ফাতেমা ট্রেডার্স নামের দোকানে মেয়েদের অন্তর্বাস বিক্রি হয়। প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়কর্মী মো. সবুজ একটি বান্ডিল (১২ পিস) দেখিয়ে বলেন, ‘ছয় মাস আগেও এটি ৯০০ টাকায় বিক্রি করেছি। এখন দাম বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৬০০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। নতুন পণ্য আমদানি একপ্রকার বন্ধ। যেসব পণ্য মজুত ছিল সেগুলোই এবার বিক্রির জন্য তোলা হয়েছে। ১০ রমজানের মধ্যে পণ্যের নতুন চালান তুলতে না পারলে ব্যবসার ক্ষতি হবে।’

গত শনিবার চকবাজারের বিভিন্ন দোকান ও এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ঘিঞ্জি এই এলাকায় সারি সারি দোকানে ঈদকে কেন্দ্র করে নতুন পণ্য তোলা হয়েছে। দোকানে থরে থরে সাজানো মেয়েদের মাথার ক্লিপ, ব্যান্ড, ব্যাগ, ফিতা, জুতা, টুথব্রাশ, মেহেদি, সাবান, শ্যাম্পু থেকে শুরু করে গলার হার, কানের দুল, হাতের চুড়ি, নাকের নথ, পায়েল, ব্রেসলেটসহ বিভিন্ন ধরনের ইমিটেশন অলংকার।

খেলনা পণ্যের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিকের গাড়ি, পিস্তল, তীর-ধনুক, রঙিন চশমা, বেলুন, রবারের ক্রিকেট বল, লাটিম, গুলতি, মার্বেলসহ ছোট ছোট বিভিন্ন পণ্য। এসব পণ্যের পাশাপাশি চকবাজারে আতর, সুরমা, টুপি, তসবিহ, মেসওয়াক, জায়নামাজ ও পাগড়িও বিক্রি হচ্ছে।

প্লাস্টিকের খেলনার দোকান ফাহিম ট্রেডার্সের মালিক আফসার উদ্দিন বলেন, ‘খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন স্থানীয় পর্যায়ে বেচাকেনা ভালো হচ্ছে না। এ কারণে তাঁরাও পণ্য কিনছেন কম। তবে কিছুদিনের মধ্যে বেচাকেনা বাড়বে বলে আশা করছি।’

অন্যান্য পণ্যের তুলনায় প্রসাধনী পণ্যের দাম বেশি বেড়েছে বলে জানান এ এলাকার ব্যবসায়ীরা। চকবাজার সিটি করপোরেশন বিপণিবিতানের প্রসাধনীর দোকান গণি কসমেটিকস অ্যান্ড জুয়েলারি। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. মারুফ জানান, গত কয়েক মাসের ব্যবধানে দামি প্রসাধনীর দাম বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। যার কারণে বিক্রি অনেক কমে গেছে।

কক্সবাজারের রামু থেকে চকবাজারে পণ্য কিনতে এসেছেন খুচরা ব্যবসায়ী মো. মামুন। আলাপকালে তিনি জানান, খুচরা পর্যায়ে ১০ রোজার পর বেচাকেনা শুরু হবে। এ জন্য আগেভাগে পণ্য কিনতে এসেছেন। চকবাজার থেকে কসমেটিকস, জুয়েলারি, হিজাব ইত্যাদি পণ্য কিনেছেন তিনি। তবে আগের চেয়ে দাম অনেক বেশি বলে জানান মামুন।

সরেজমিনে গত শনিবার কথা হয় খিলগাঁও থেকে চকবাজারে পণ্য কিনতে আসা খুচরা ব্যবসায়ী মো. আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন যদি টাকা থাকে তাহলে এখনই পণ্য কিনে রাখতে। কারণ, পরে দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।