যেভাবে এখন ‘হলুদের দেশ’ রাজশাহীর আড়ানী

আজ থেকে ৫২ বছর আগের কথা। মো. সিদ্দিক মোল্লা তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন। তখন প্রতিদিন আড়ানী থেকে ১০ কেজি হলুদ নিয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কাঁকনহাটে গিয়ে বিক্রি করতেন। সেই ব্যবসা বেড়ে এখন অনেক বড় হয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠান বছরে অন্তত এক হাজার টন শুকনা হলুদ তিনটি কোম্পানিসহ দেশের ৫০ থেকে ৬০টি জায়গায় সরবরাহ করে। এই কর্মযজ্ঞ দেখে রাজশাহীর আড়ানী পৌর এলাকা ও এর আশপাশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০০ জন হলুদের কারবারে নিয়োজিত রয়েছেন।

এসব ব্যবসায়ী কাঁচা হলুদ কিনে প্রক্রিয়াজাত করে পাঁচটি গ্রেড তৈরি করেন। ব্যবসায়ীদের হিসাবমতে, প্রতিবছর আড়ানীতে হলুদ ব্যবসায় প্রায় ৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। এই ব্যবসায় কর্মসংস্থান হয়েছে সহস্রাধিক মানুষের। হলুদের মৌসুমে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পায় আড়ানী, আর পুরো এলাকাটি যেন হলুদময় হয়ে ওঠে।

হলুদ ব্যবসার বড় প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে আড়ানী পৌর এলাকার চকসিংগা মহল্লায়। আর সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী হলেন মো. সিদ্দিক মোল্লা। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম আড়ানী ট্রেডার্স, যেখানে শ খানেক শ্রমিক কাজ করেন।

সরেজমিনে সম্প্রতি আড়ানী-বাঘা সড়কের পাশে সিদ্দিক মোল্লার আড়ানী ট্রেডার্সে গিয়ে ৮৫ জন শ্রমিক-কর্মচারীকে কাজ করতে দেখা গেছে। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী। তাঁদের আয়েই চলে সংসার। কারণ, তাঁরা নিঃস্ব-নিরীহ পরিবারের, যাঁদের অনেকের স্বামী নেই। আবার অনেকের স্বামী থাকলেও কাজ করতে পারেন না।

আশার কথা হচ্ছে, হলুদ ব্যবসায়ীদের কারখানায় কাজ করে অনেক নারীর ভাগ্য ফিরেছে। যেমন চকসিংগা গ্রামের প্রায় সব শ্রমিকের বাড়িতে ইতিমধ্যে পাকা ঘর উঠেছে। আড়ানী ট্রেডার্সেই কথা হলো শেফালী বেগমের (৩৭) সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর স্বামী শারীরিক প্রতিবন্ধী। কোনো কাজ করতে পারেন না। ছেলেমেয়ে তিনজন। তিনি হলুদের কারখানায় কাজ করে দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি পান। তা দিয়েই চলে সংসারের খরচ।

আড়ানীতে হলুদ ব্যবসার পথিকৃৎ মো. সিদ্দিক মোল্লা তাঁর আড়ানী ট্রেডার্সে বসে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, চার প্রজন্ম ধরে তাঁরা হলুদের ব্যবসা করছেন। আগে তাঁর বাপ-দাদা হলুদের ব্যবসা করতেন, এখন তাঁর ছেলেও এই ব্যবসা করছেন।

বর্তমানে আড়ানীর বড় হলুদ ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছেন নূর মোহাম্মদ মোল্লা, কুদ্দুস মোল্লা, জাহাঙ্গীর মোল্লা, নূহু মুন্সী ও হাবি মোল্লা।

হলুদ ব্যবসার সেকাল-একাল

আগে হলুদ কেনার জন্য কোনো কোম্পানি ছিল না। তখন যেসব জায়গায় হলুদের চাষ হতো না, ব্যবসায়ীরা সেখানে গিয়ে এটি বিক্রি করতেন। যেমন ১৯৭২ সালে আড়ানীর ব্যবসায়ীরা রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কাঁকনহাটে হলুদ বিক্রি করতে যেতেন। তখন সরকার আইন করেছিল, ১০ কেজির বেশি মাল এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাহলে তা পাচার বলে গণ্য হবে।

মো. সিদ্দিক মোল্লার বাবা ইয়াসিন মোল্লাসহ আড়ানীর ২৪ জন ব্যবসায়ী ১১০ বস্তা হলুদ নিয়ে কাঁকনহাটে বিক্রি করতে গিয়েছিলেন। প্রতি বস্তায় ১০০ কেজি করে হলুদ ছিল। সে জন্য হলুদ পাচারের অভিযোগে তখন রক্ষী বাহিনী সব ব্যবসায়ীকে আটক করে। হলুদ জব্দ করে আদালতে চালান দেয়। পরে অবশ্য ব্যবসায়ীদের সবাই আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাস পেয়েছিলেন। হলুদও ফেরত পান তাঁরা।

হলুদের গ্রেডিং

আড়ানীর ব্যবসায়ীরা প্রথমে কাঁচা হলুদ কিনে শুকিয়ে গ্রেডিং করেন। গ্রেড তৈরি করেন পাঁচটি। এর মধ্য থেকে স্পেশাল কোয়ালিটি, তথা বিশেষ মানসম্পন্ন হলুদ নেয় দেশের শীর্ষস্থানীয় চারটি কোম্পানি।

মোটা সাইজের হলুদকে স্থানীয়ভাবে বলা হয়, ‘ভোট’। বাছাইয়ের পর আরও দুই ধরনের হলুদ হয়। তা হলো ‘মাঝারি’ ও ‘কুচি’। স্পেশাল হলুদ বড় চার কোম্পানি নেয়। বাকি হলুদ অন্য ব্যবসায়ীরা কিনে নেন।

হলুদ ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানো

আড়ানীতে ২০১০ সালে শুকনা হলুদের মণ ছিল ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা। তার পর থেকে হলুদের দাম পড়ে যায়। এক যুগ, মানে ১২ বছর পর ২০২৩ সালে হলুদের দাম বৃদ্ধি পায়। প্রতি মণ ৬ হাজার টাকায় ওঠে। এবার তো প্রতি মণের দাম আরও বেড়ে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা উঠেছে। এরই মধ্যে আড়ানীর ব্যবসায়ীরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন।

হলুদের আবাদ বেড়েছে। বাড়িতে বাড়িতে হলুদ শুকানোর আগের সেই দৃশ্য আবার ফিরে এসেছে। মাঠেও ইটখোলার মতো ‘হলুদখোলা’ (যেখানে হলুদ সেদ্ধ করা হয়) তৈরি করেছেন ব্যবসায়ীরা।

চকসিংগা মাঠের ভেতরে হলুদখোলা তৈরি করেছেন ব্যবসায়ী রমজান আলী। তিনি বলেন, ১০ বছরের মধ্যে হলুদের এত দাম ছিল না। গত বছর কাঁচা হলুদের মণ ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা। এবার প্রথমে ১ হাজার ৮০০ ছিল। পরে তা বেড়ে ২ হাজার ৬০০ টাকায় উঠেছে। এবার তিনি ৬০০ মণ কাঁচা হলুদ কিনেছেন।

রমজান আলীর পাশের হলুদখোলায় গিয়ে জানা যায়, সেখানে ব্যবসায়ী জাকির হোসেনের চার হাজার মণ হলুদ শুকানোর কাজ চলছে। সব মিলিয়ে হলুদের ব্যবসা এই এলাকায় কর্মচাঞ্চল্য তৈরি করেছে।