ঝালকাঠি বিসিক শিল্পনগরী
৭৯টি প্লটের মধ্যে ৭৭টিই খালি
২৭ জন উদ্যোক্তা এ শিল্পনগরীতে ৫০টি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। কিন্তু কারখানা চালু হয়েছে মাত্র ২টিতে। বাকিরা সুবিধা না পাওয়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
ঝালকাঠি বিসিক শিল্পনগরীতে লায়লা অ্যাগ্রোর নামে তিন কাঠার তিনটি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা মো. জামাল শরীফ। তাঁর ইচ্ছা, এসব প্লটে একটি ডালের মিল করবেন। প্লটের প্রথম আবেদনের সময় জমির ভাড়া বাবদ নির্ধারিত অর্থের দুই ভাগ জমাও দিয়েছেন। বাকি টাকা ৪ বছরে মোট ১০ কিস্তিতে পরিশোধ করে ৯৯ বছরের জন্য প্লট বুঝে পাওয়ার কথা। কিন্তু সরাসরি জমির মালিকানা না থাকায় কোনো ব্যাংক উদ্যোক্তা জামাল শরীফকে ঋণ দিতে রাজি হচ্ছে না। তাই জামাল শরীফ বিসিক কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর প্লটের বরাদ্দ বাতিলের আবেদন করেছেন।
শুধু জামাল শরীফই নন, ঝালকাঠি বিসিকে প্লটের বেশি দাম এবং প্লটের বিপরীতে ব্যাংকঋণ না পাওয়ায় অনেক উদ্যোক্তাই এখন সেখানে কারখানা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তাই ঝালকাঠি বিসিক শিল্পনগরীর ৭৯টি প্লটের মধ্যে ৭৭টিই ফাঁকা পড়ে আছে। এখন পর্যন্ত ২৭ জন উদ্যোক্তাকে ৫০টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব প্লটের মধ্যে দুটি বাদে বাকিগুলোতে কোনো শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি।
বিসিক সূত্রে জানা যায়, যে দুটি কারখানা উৎপাদনে এসেছে সেগুলো হলো সারেং ফার্নিচার ও রাইসা পলিমার। বাকি ১ জন উদ্যোক্তার বিপরীতে ২৫টি প্লট বরাদ্দের অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন। বাকি উদ্যোক্তারা প্লট নিয়েও কারখানা তৈরি কাজ শুরু করেননি। এদিকে পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণাঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু ঝালকাঠি বিসিক এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। এ শিল্পনগরীতে কারখানা করতে আগ্রহী হচ্ছেন না উদ্যোক্তারা।
প্লাস্টিকের পাইপ তৈরির একটি কারখানা করতে চীন থেকে যন্ত্রপাতি আনার চেষ্টা করেও আনতে পারছি না। কারণ, কোনো ব্যাংক ঋণপত্র খুলছে না। কিন্তু বসে বসে বিসিকের কিস্তি দিয়ে যেতে হচ্ছে।’আবদুস সাত্তার, মালিক, সুন্দরবন পলিমার
শহরের সুতালরী খালসংলগ্ন বরিশাল-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে প্রায় ১১ একর জমির ওপর ঝালকাঠি বিসিক শিল্পনগরী স্থাপন করা হয়। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে এ শিল্পনগরীর কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ২০১৯ সালের জুনে। ১৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ বিসিক শিল্পনগরীতে ৭৯টি প্লট রয়েছে। ২০১৯ সালে এ শিল্পনগরীতে প্লট বরাদ্দ শুরু হয়। প্লটের প্রতি শতাংশের দাম ধরা হয় ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। প্লট বরাদ্দের শর্ত অনুযায়ী, ৩১ মাসের মধ্যে উৎপাদনে যেতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উৎপাদন শুরু করতে না পারলে বরাদ্দ বাতিল করা হবে। তবে অধিকাংশ শিল্পোদ্যোক্তা এসব প্লটের বিপরীতে ব্যাংকঋণ না পাওয়ায় কারখানা করতে পারছেন না।
সৌদিপ্রবাসী হাফিজুর রহমান ৪টি প্লট নিয়ে গড়ে তোলেন খাঁটি শর্ষের তেলের মিল (অয়েল অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি)। নিজের পুঁজি ও পৈতৃক কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে প্রায় দুই কোটি টাকায় এ কারখানা গড়ে তুলছেন। দৈনিক পাঁচ মেট্রিক টন শর্ষের তেল উৎপাদনের আশা এই উদ্যোক্তার। পাশাপাশি গবাদিপশুর গোখাদ্য ও মাছের খাবার তৈরির কারখানাও গড়ে তোলা হচ্ছে। হাফিজুর রহমান বলেন, তাঁর এই কারখানাকে উৎপাদনের পর্যায় আনতে আরও এক কোটি টাকা প্রয়োজন। তাই তিনি বিসিকের জমি বন্ধক রেখে ঋণের জন্য ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ৯ মাস ধরে একাধিক ব্যাংকে ঘুরেও কোনো ঋণ পাননি তিনি। এখন আরেকটি ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণের চেষ্টা করছেন।
এ শিল্পনগরীতে মালয়েশিয়াপ্রবাসী আরেক উদ্যোক্তা হানিফ সিকদার টিস্যু ব্যাগ তৈরির একটি কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। হানিফ সিকদার বলেন, ‘জেলা সদরের বিনয়কাঠিতে টিস্যু ব্যাগ তৈরির একটি কারখানা রয়েছে আমার। সেখানে সীমিত আকারে পণ্য তৈরি হয়। তাই বিসিকে প্লট নিয়ে বড় আকারে কারখানাটি চালু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিন কিস্তিতে ১০ লাখ টাকা দেওয়ার পরও এখন পর্যন্ত কোনো কাজ করতে পারিনি। যন্ত্রপাতি কেনার জন্য একটি ব্যাংকের কাছে ঋণের আবেদন করেও কোনো সাড়া পেলাম না। এ অবস্থায় নিজের জমানো টাকা ও ধারদেনা করে প্লটের কিস্তি চালিয়ে যাচ্ছি।’
আরেক উদ্যোক্তা সুন্দরবন পলিমারের মালিক আবদুস সাত্তার বলেন, ‘প্লাস্টিকের পাইপ তৈরির একটি কারখানা করতে চীন থেকে যন্ত্রপাতি আনার চেষ্টা করেও আনতে পারছি না। কারণ, কোনো ব্যাংক ঋণপত্র খুলছে না। কিন্তু বসে বসে বিসিকের কিস্তি দিয়ে যেতে হচ্ছে।’ আবদুস সাত্তার বলেন, ‘বিসিকে শিল্পকারখানা করার উদ্যোগ নিলেও ব্যাংকের কোনো সহযোগিতাই আমরা পাচ্ছি না।’
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের ঝালকাঠি শাখার বিনিয়োগ বিভাগের প্রধান মো. সফিকুল হক জানান, ‘আমরা অবশ্যই শিল্পে বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত। কিন্তু সমস্যা হলো, বিসিকের প্লটগুলো সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া, কিস্তি শোধ না হওয়া পর্যন্ত এসব প্লটের বিপরীতে ব্যাংকের পক্ষে ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়।’
ঝালকাঠি বিসিক শিল্পনগরীর উপব্যবস্থাপক শাফাউল করিম জানান, সব শর্ত পূরণ করেই উদ্যোক্তারা প্লট নিয়েছেন। এই মুহূর্তে উদ্যোক্তারা প্লটের মালিক না হওয়ায় ব্যাংকঋণ পাচ্ছেন না। তবে তাঁরা কিস্তির পুরো টাকা পরিশোধ করে অনাপত্তিপত্র নিলে ব্যাংক ঋণের বিষয়টি বিবেচনা করবে।
এদিকে জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল বলেন, উদ্যোক্তারা যাতে সহজ শর্তে ঋণ পান, সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে। আর প্লট নিয়ে যাঁরা কারখানা করছেন না, তাঁদের বরাদ্দ বাতিলের বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সভায় আলোচনা হবে।