সাভার চামড়াশিল্প নগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) বেশির ভাগ যন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে গেছে। বর্তমানে সিইটিপির ২০ টির বেশি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ নষ্ট। শিল্পনগরীর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে এ প্রতিবেদন তৈরি করে বিসিক।
বিসিক বলছে, যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকায় চামড়াশিল্প নগরীর বর্জ্য পরিশোধনে অধিকাংশ মানমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। তাই সিইটিপি সংস্কারে নতুন প্রকল্প নিতে চায় শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিক। বিসিক শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সংস্থা।
এদিকে নতুন প্রকল্প নিতে চাইলেও এ জন্য সরকারি অর্থায়ন মিলছে না। তাই বেসরকারি বিনিয়োগে সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়নে বিনিয়োগকারী খুঁজছে সংস্থাটি। ইতিমধ্যে একাধিক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে প্রস্তাবনা দিয়েছে। কিন্তু নানা জটিলতায় এসব প্রস্তাব আলোর মুখ দেখছে না।
এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমপ্লায়েন্স না থাকায় আমরা সম্ভাবনাময় চামড়া রপ্তানিতে বিপুল আয় হারাচ্ছি। চামড়াশিল্প নগরীর সিইটিপিতে শুরু থেকেই সমস্যা রয়েছে। আমরা সেটি সংস্কারের জন্য নতুন প্রকল্পের বিষয়টি যাচাই করে দেখছি।’
সিইটিপির বর্তমান অবস্থা
বুড়িগঙ্গা নদী ও ঢাকার দূষণ কমাতে ২০০৩ সালে সাভারে চামড়াশিল্প নগরীর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের অধীনে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকায় সাভারের হেমায়েতপুরে ১৯৯ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেওয়া হয় সাভারে। সেখানে ২০১২ সালে একটি চীনা কোম্পানি ৫৪৭ কোটি টাকায় সিইটিপি নির্মাণের কাজ পায়। কিন্তু সিইটিপির নির্মাণকাজে ত্রুটি থাকায় শুরু থেকে এটি ঠিকভাবে কার্যকর ছিল না। এখন বিসিক বলছে, সিইটিপির কার্যক্ষমতা অনেক কমে গেছে।
বিসিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিইটিপির ডিওয়াটারিং হাউসের নয়টি ফিল্টার প্রেস যন্ত্রের মধ্যে বর্তমানে সচল আছে মাত্র দুটি। অথচ অন্তত ছয়টি ফিল্টার সব সময় সক্রিয় রাখতে হয়। অন্যথায় ফিল্টার প্রেসের মাধ্যমে স্লাজ আলাদা করা সম্ভব হয় না। সিইটিপিতে স্লাজ ট্রান্সফার পাম্প রয়েছে আটটি। এর মধ্যে চারটিই নষ্ট। এর বাইরে পাম্প, মোটর, ব্লোয়ার ও ইলেকট্রো মেকানিক্যাল উপকরণগুলোও ক্ষয়ে গেছে। ২৭টি ব্লোয়ারের মধ্যে সক্রিয় এখন ৫ টি। এ কারণে বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট ঠিকভাবে কাজ করছে না। আবার ইকুয়ালাইজেশন ট্যাংকের চারটি পাম্পের মধ্যে দুটি নষ্ট। এতে দ্রবীভূত তরলের মধ্যে পর্যাপ্ত বায়ু সঞ্চালনের অভাবে ক্ষতিকর হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে।
সিইটিপির নকশায় কারিগরি ত্রুটি রয়েছে। সিইটিপি দীর্ঘদিন ধরে নিম্ন কার্যক্ষমতায় চালু থাকলেও যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ নিয়মিত মেরামত ও কার্যকরে কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও উদাসীনতা রয়েছে।
পরিবেশের দূষণ বাড়ছে
বিসিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিইটিপিতে দৈনিক প্রায় ২০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার বেশির ভাগই উন্মুক্ত ডাম্পিং ইয়ার্ডে ফেলা হচ্ছে। এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।
এ ছাড়া সিইটিপির দৈনিক তরল বর্জ্য পরিশোধনের ক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটার। কিন্তু বর্তমানে এই সক্ষমতার ৫৫ ভাগ ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে প্রতিদিনই তরল বর্জ্যের বড় একটি অংশ পরিশোধন ছাড়াই চামড়াশিল্প নগরীর পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছে বিসিক।
সংস্থাটি বলছে, কোরবানির সময় এ শিল্পনগরে ৪০ হাজার ঘনমিটার পর্যন্ত তরল বর্জ্য তৈরি হয়। তাই দ্রুত সিইটিপি ঠিক করা না হলে আসছে কোরবানি মৌসুমে দূষণ সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
বিসিক কর্মকর্তারা জানান, ট্যানারিগুলো থেকে উৎপন্ন ইফ্লুয়েন্টে (বর্জ্য) ক্রোমসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর জৈব-অজৈব দূষক পদার্থ থাকে। পরিবেশে ছাড়ার আগে এগুলো অন্তত ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধন করা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে সিইটিপিতে বর্জ্য পরিশোধনের হার ৮৫-৯০ শতাংশ। অর্থাৎ বর্জ্য পরিশোধনের অধিকাংশ মানমাত্রাই অর্জিত হচ্ছে না।
পরিবেশদূষণের কারণে নিয়মিত জরিমানাও গুনতে হচ্ছে সিইটিপি কর্তৃপক্ষকে। সিইটিপির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানি। ২০২১ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত কোম্পানিকে ২ কোটি ৩৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
তবু মাশুল বাড়ানোর সুপারিশ
বিসিক বলছে, সিইটিপির নকশায় কারিগরি ত্রুটি রয়েছে। এ ছাড়া নেই কোনো স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর। সিইটিপির যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নেই কোনো লিখিত পরিকল্পনাও। সিইটিপি দীর্ঘদিন ধরে নিম্ন কার্যক্ষমতায় চালু থাকলেও যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ নিয়মিত মেরামত ও কার্যকরে কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও উদাসীনতা রয়েছে।
এ অবস্থায় সিইটিপিতে বর্জ্য পরিশোধনের মাশুল বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বিসিক। বর্তমানে বর্জ্য পরিশোধন মাশুল প্রতি ঘনমিটারে ২৫ টাকা। সেটি বাড়িয়ে ৯০ টাকা করার সুপারিশ করেছে বিসিক। এ ছাড়া পানির মাশুল ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা এবং যেসব প্রতিষ্ঠান নিজেরা পানির পাম্প বসিয়ে পানি তোলে, তাদের ক্ষেত্রে মাশুল ১০ টাকার পরিবর্তে ১৫ টাকা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
বিসিকের তথ্য অনুসারে, বর্তমান সিইটিপিকে কার্যকর করতে শতাধিক যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন করতে হবে। এ কাজে অন্তত ১৪১ কোটি থেকে ১৬১ কোটি টাকা দরকার। এর বাইরে সিইটিপি পরিচালনার জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর তৈরি এবং যন্ত্রপাতি মেরামত ও প্রতিস্থাপনের জন্য একটি স্থায়ী তহবিল গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
অনভিজ্ঞ কাউকে সিইটিপির সংস্কারের কাজ দেওয়া ঠিক হবে না। এ প্রকল্প চূড়ান্ত করার আগে ভালো করে যাচাই–বাছাই করে নিতে হবে, যেন অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয়।শাহীন আহমেদ, চেয়ারম্যান, বিটিএ
সংস্কারের উদ্যোগে সাড়া নেই
সাভারের চামড়াশিল্প নগরীর সিইটিপি সংস্কার ও উন্নয়নে নতুন উদ্যোগ নেওয়ার কথা বছর দু-এক ধরে বলে আসছে বিসিক ও শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু তাতে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে সাড়া মিলছে না। তবে অনভিজ্ঞ কোনো প্রতিষ্ঠানকে এ সংস্কারকাজ দেওয়ার বিরোধিতা করছে এ শিল্পনগরীর উদ্যোক্তারাও। তাঁরা বলছেন, ইউরোপীয় মান নিশ্চিত করে সরকারের উদ্যোগে এ কাজ করা হোক। অন্যথায় স্থানীয় উদ্যোক্তাদের অর্থ দিয়ে এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হোক।
সরকারের শীর্ষ মহল থেকে সিইটিপি সংস্কারের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ার অন্যতম কারণ ইতিপূর্বে বিপুল ব্যয়ে সরকার সিইটিপি স্থাপন করলেও তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য এ খাতে নতুন করে অর্থ খরচ করতে নারাজ সরকারের একাংশ। তারা এ ব্যর্থতার দায় দিচ্ছে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিকের ঘাড়ে। মূলত বিসিক ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের গাফিলতির কারণে সাভার চামড়াশিল্প নগরী আরেকটি হাজারীবাগে পরিণত হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্প নগরী সাভারে সরানো হয়েছিল, তার সুফল মিলছে না। বুড়িগঙ্গার বদলে ধলেশ্বরী নদী এখন দূষণের কবলে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বলেন, অনভিজ্ঞ কাউকে সিইটিপির সংস্কারের কাজ দেওয়া ঠিক হবে না। এ প্রকল্প চূড়ান্ত করার আগে ভালো করে যাচাই–বাছাই করে নিতে হবে, যেন অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয়।
এদিকে সিইটিপি সংস্কারে বিনিয়োগের জন্য ইতিমধ্যে ভারত, চীন ও ইউরোপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু নানা কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব বেশি দূর এগোয়নি। সর্বশেষ দেশের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি যৌথ উদ্যোগে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিইটিপি সংস্কার ও উন্নয়নের একটি প্রস্তাব দেয় বিসিককে। সেই প্রস্তাব শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বিসিক। কিন্তু প্রস্তাবটি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত সায় পায়নি।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জাকিয়া সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিইটিপির সংস্কারে শিল্প মন্ত্রণালয় সরকারি মালিকানাধীন আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) বা বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেডের (বিআইএফএফএল) মাধ্যমে অর্থায়নের বিষয়টি যাচাই–বাছাই করছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগ কিংবা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। সিইটিপির সংস্কার এখন আমাদের কাছে অগ্রাধিকার বিষয়।’