সুগন্ধি চালসহ কিছু পণ্যে বছরের পর বছর রপ্তানি কম, প্রণোদনা বেশি

বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত চাল রপ্তানি হয় না। সরকারের অনুমতি নিয়ে মাঝেমধ্যে সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়। সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে কোনো সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়নি। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫১ লাখ মার্কিন ডলারের সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়েছিল। অনিয়মিতভাবে পরিমাণে সামান্য রপ্তানি হলেও সুগন্ধি চালে অনেক দিন ধরেই ১৫ শতাংশ নগদ ভর্তুকি বা প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

সুগন্ধি চালের মতো বেশ কয়েকটি পণ্যের রপ্তানি বছরের পর বছর ধরে খুব বেশি না, অথচ এসব পণ্যে উচ্চ হারে নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সেই সহায়তা অব্যাহত রাখা হয়েছে। পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে ও রপ্তানি বাড়াতে করের টাকায় বছরের পর বছর সরকার বিভিন্ন খাতে নগদ প্রণোদনা দিলেও রপ্তানি বহুমুখীকরণের বিষয়টি এখনো আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ।

৮০ শতাংশের বেশি রপ্তানি একটি খাত তথা পোশাক খাতনির্ভর। ফলে অনেক ধরনের পণ্যে বছরের পর বছর নগদ সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার এ নগদ সহায়তা নিয়ে অনিয়মের ঘটনাও কম নয়। রপ্তানি না করেও ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে নগদ সহায়তার অর্থ তুলে নিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার চলতি অর্থবছরে রপ্তানির বিপরীতে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তার তালিকা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে সব মিলিয়ে পণ্য রপ্তানিতে ৪৩ খাতে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বনিম্ন ১ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, রপ্তানি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বিনিয়োগ আকর্ষণ, শিল্পায়নে ভূমিকা এবং অপ্রচলিত পণ্যকে উৎসাহিত করতে নগদ সহায়তা বা প্রণোদনা দেয় সরকার। আদর্শগতভাবে এটি অন্ততকাল ধরে দেওয়া যায় না। প্রণোদনার কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন আছে।

নির্দিষ্ট সময় পর তা পুনর্বিবেচনা না করলে রপ্তানি খাতের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জিত হয় না। উল্টো জনগণের কর টাকার অপচয় হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, গত অর্থবছরের মতো এবারও রপ্তানিতে আটটি খাত সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ প্রণোদনা পাবে। খাতগুলো হচ্ছে শাকসবজি, ফলমূল ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য খাত; বৈচিত্র্যকৃত পাটপণ্য; অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস (এপিআই) রপ্তানি; শতভাগ হালাল মাংস ও হালাল মাংসজাতীয় পণ্য; আলু রপ্তানি; পাটকাঠি থেকে উৎপাদিত কার্বন ও জুট পার্টিকেল বোর্ড; শস্য, শাকসবজির বীজ এবং আগর ও আতর পণ্য রপ্তানি খাত।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, সর্বোচ্চ প্রণোদনা পাওয়া আট খাতের মধ্যে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি সবচেয়ে বেশি। গত অর্থবছর ৮৪ কোটি ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর আগের বছর রপ্তানি হয়েছিল ১১৬ কোটি ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য। বাকি সাত খাতের রপ্তানি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।

সরকার রপ্তানিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয় ছয় খাতে। এর মধ্যে রয়েছে হালকা প্রকৌশল পণ্য; চামড়াজাত দ্রব্য; আসবাব; অ্যাকুমুলেটর ব্যাটারি; সিনথেটিক ও ফেব্রিকসের মিশ্রণে তৈরি পাদুকা ও ব্যাগ এবং চাল রপ্তানি খাতে। ১২ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হয় একটি খাতে। সেটি হলো পাটজাত চূড়ান্ত দ্রব্য রপ্তানি খাত তথা হেসিয়ান, স্যাকিং ও সিবিসি রপ্তানিতে।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নগদ সহায়তা পাওয়া ছয় খাতের মধ্যে অ্যাকুমুলেটর ব্যাটারি রপ্তানি গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ২ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে পণ্যটির রপ্তানি ছিল ৩ কোটি ২৮ লাখ ডলার। অন্যদিকে বিদায়ী অর্থবছর আসবাব রপ্তানি হয়েছে ৯ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে আসবাবের রপ্তানি ছিল ১১ কোটি ডলার। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে দুই খাতের রপ্তানি কমেছে।

এ ছাড়া ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি খাতে। এর মধ্যে রয়েছে হিমায়িত চিংড়ি; সাভারে চামড়াশিল্প নগরে অবস্থিত কারখানা ও সাভারের বাইরে অবস্থিত কারখানায় যেখানে নিজস্ব ইটিপি রয়েছে, এমন কারখানায় উৎপাদিত ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া, প্লাস্টিক দ্রব্য, কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য, সফটওয়্যার, আইটিইএস ও হার্ডওয়্যার, জাহাজ রপ্তানি, ওষুধ পণ্য, হস্তশিল্প, গরু ও মহিষের নাড়ি-ভুঁড়ি-শিং; পেট বোতল-ফ্লেক্স, ফটোভোলাটিক মডিউল, মোটরসাইকেল, রাসায়নিক, রেজার ও রেজার ব্লেডস, সিরামিক পণ্য, টুপি, কাঁকড়া ও কুঁচে, গ্যালভানাইজ শিট; ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক হোম ও কিচেন পণ্য রপ্তানি খাত। এই পণ্যগুলোর অধিকাংশই অপ্রচলিত হলেও রপ্তানির পরিমাণ অনেক কম।

দেশের পণ্য রপ্তানিতে শীর্ষে থাকা তৈরি পোশাক খাতও রপ্তানির বিপরীতে প্রণোদনা পায়। অন্য খাতের চেয়ে এ খাতে প্রণোদনার হার কম হলেও রপ্তানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় ভর্তুকি বেশি পাচ্ছে এই খাত। অন্যদিকে চা, দেশে তৈরি বাইসাইকেল ও যন্ত্রাংশ, এমএস পণ্য এবং সিমেন্ট শিট রপ্তানিতে ভর্তুকি ৪ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছর চায়ের রপ্তানি ছিল ২৩ লাখ ডলার আর বাইসাইকেলের রপ্তানি ছিল ১৪ কোটি ডলার।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানির বিপরীতে সরকার যে প্রণোদনা দেয়, তা ঢেলে সাজানো দরকার। প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে সময় নির্দিষ্ট করা এবং নির্ধারিত সময় শেষে তা বন্ধ করতে হবে। প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজস্ব ব্যয়ের হিসাবটিও করা দরকার। নিয়মিতভাবে প্রণোদনার বিষয়টি মূল্যায়ন করতে হবে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হলে এভাবে প্রণোদনা দেওয়া যাবে না। সে কারণে সীমিত সময়ের মধ্যে প্রণোদনা পুনর্মূল্যায়ন দরকার।