এবার যশোরের সাফ লেদার পেল আন্তর্জাতিক সনদ

এ নিয়ে দেশে এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া চামড়া কারখানার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৫। সব কটিই সাভারের চামড়াশিল্প নগরের বাইরে অবস্থিত।

শেখ আফিল উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড
সংগৃহীত

দেশের আরেকটি ট্যানারি বা চামড়া কারখানা আন্তর্জাতিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পেয়েছে। নতুন সনদ পাওয়া ট্যানারিটি হচ্ছে যশোরের এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, যা সাফ লেদার নামেও পরিচিত। প্রতিষ্ঠানটি এলডব্লিউজির গোল্ড সনদ পেয়েছে।  

সব প্রস্তুতি শেষে চলতি বছরের জুলাই মাসে এলডব্লিউজি সনদের জন্য নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয় সাফ লেদার। গত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়। এর এক মাসের মাথায় গত ১৫ নভেম্বর সনদ হাতে পায় প্রতিষ্ঠানটি।  

এ নিয়ে দেশে এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া চামড়া কারখানার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল পাঁচ। এগুলো হচ্ছে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, রিফ লেদার, এবিসি লেদার, সুপারেক্স লেদার ও এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ। তবে দেশে এই সনদ পাওয়া সব কটি কারখানাই সাভারের চামড়াশিল্প নগরের বাইরে অবস্থিত। চামড়াশিল্প নগরে বর্তমানে ১৪২টি ট্যানারি রয়েছে।

৬৫ বছরের প্রতিষ্ঠান

১৯৫৮ সালে ‘স্কটিশ অ্যান্ড ফ্যামিলি’ নামে যুক্তরাজ্যের একটি ব্যবসায়িক পরিবারের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজের। যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদের তীরে প্রায় ১২ একর জমিতে এটি গড়ে তোলা হয়। ১৯৭৬ সালে বিদেশি মালিকের কাছ থেকে কারখানাটি কিনে নেন আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিন। ওয়েট ব্লু দিয়ে যাত্রা শুরু করে কয়েক বছরের মধ্যে ক্রাস্ট এবং পরবর্তী সময়ে ফিনিশড লেদার উৎপাদন শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে সাত শতাধিক কর্মী কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে নারী ১২৫ জন। বছরের ২৯০ দিন উৎপাদন কাজ চলে কারখানাটিতে। মাসে ১৫ লাখ বর্গফুট উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে এটির। জাতীয় রপ্তানিতে অবদানের জন্য ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চারবার স্বর্ণপদক ও বেশ কয়েকবার রৌপ্যপদক পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিনের ছেলে সেখ মোমিন উদ্দিন দীর্ঘদিন সাফ লেদারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। করোনাকালে তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর ভাই স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আফিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ আফিল উদ্দিন প্রতিষ্ঠানটির এমডির দায়িত্বে রয়েছেন।  

প্রথমবারেই গোল্ড সনদ

দেশে এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে এত দিন শুধু অ্যাপেক্সের গোল্ড সনদ ছিল। এবার সেই তালিকায় সাফ লেদারের নাম উঠল। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমবার আবেদন করেই গোল্ড সনদ পেয়েছে। এই দুটি প্রতিষ্ঠান বাদে বাকি তিনটি ট্যানারি পেয়েছে এলডব্লিউজির সিলভার সনদ।

গোল্ড সনদ পাওয়ার বিষয়ে সাফ লেদারের এমডি সেখ আফিল উদ্দিন বলেন, ‘এটা অত্যন্ত আনন্দের। এলডব্লিউজি স্বীকৃতি পাওয়া একটি দলগত প্রচেষ্টার ফল। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং সবার অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টার কারণে এ স্বীকৃতি পেয়েছি আমরা।’  
বর্তমানে সাফ লেদার মাসে ছয় লাখ বর্গফুট চামড়া রপ্তানি করে। এলডব্লিউজি সনদ পাওয়ায় রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ বাড়বে বলে আশা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এলডব্লিউজি স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য ২০১৮ সালে কার্যক্রম শুরু করা হয় বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। তাঁরা জানান, এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদেক্ষেপ ছিল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন।  

১০৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ

সাফ লেদার কারখানায় এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ করা হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে ইটিপি স্থাপনে, যা চালু হয় ২০২০ সালে। ২৭ হাজার বর্গফুট জায়গায় স্থাপিত ইটিপিতে দৈনিক ৮০০ ঘনমিটার বর্জ্য পানি পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে। ইটিপি স্থাপন ছাড়াও পৃথক ক্রোম রিকভারি প্ল্যান্ট ও আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে কারখানায়। এ ক্ষেত্রে ইতালি, জাপান, জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়ার যন্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে জিরো লিকুইড ডিসচার্জ, রিভার্স অসমোসিস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারসহ পরিবেশসম্মত বিভিন্ন প্রযুক্তি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান সাফ লেদারের কর্মকর্তারা।

চামড়াশিল্প নগরের অবস্থা

চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস জুলাই–নভেম্বরে তৈরি পোশাকের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪২ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে চামড়া খাত থেকে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ২০ শতাংশ কম। মূলত চামড়াশিল্প খাতে পরিবেশ সক্ষমতার অভাবে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিতে ভালো করতে পারছে না স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকেরা।
সংগৃহীত

দেশের বেশির ভাগ ট্যানারি সাভারের চামড়াশিল্প নগরে অবস্থিত। তবে সেখানে থাকা ১৪২টি ট্যানারির একটিও এখনো এলডব্লিউজি স্বীকৃতি পায়নি। সেখানে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) থাকলেও তা মানসম্মত নয় এবং পরিবেশদূষণ অব্যাহত রয়েছে। সে কারণে সাভারের চামড়াশিল্প নগরের কোনো ট্যানারি এখন পর্যন্ত এলডব্লিউজি সনদ পায়নি। দেশের যে পাঁচটি কারখানা এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে, সেগুলোর সব কটিই নিজস্ব বিনিয়োগে ইটিপি স্থাপন করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছে। এটিই তাদের সনদ অর্জনের পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।  

৪ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ জানান, এলডব্লিউজি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় শিল্পনগরের অকার্যকর সিইটিপি ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। সিইটিপি ঠিক হলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে সাভারের ৫-১০টি ট্যানারি এলডব্লিউজি সনদ পেতে পারে।  
ইউরোপের বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলো এলডব্লিউজি সনদধারী প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্যান্য কারখানা থেকে চামড়া বা চামড়াজাত পণ্য কেনে না। এ কারণে বড় বড় ক্রেতা ও ব্র্যান্ডের কাছে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এলডব্লিউজি সনদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।