গ্রামীণ ইউনিক্লো বন্ধ করার কারণ সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে

গ্রামীণ ইউনিক্লো

এক দশকের পথচলায় গ্রামীণ ইউনিক্লো বর্তমানে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের পরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর একটি। তবে গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ ব্র্যান্ডটির কার্যক্রম বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে ইউনিক্লো সোশ্যাল বিজনেস বাংলাদেশ লিমিটেড। ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ১৮ জুনের পর গ্রামীণ ইউনিক্লোর বিক্রয়কেন্দ্রগুলোর ফটক খুলবে না। ক্রেতাদের স্বাগত জানাতে কর্মীদের সমস্বরে বলা সেই কথাও আর শোনা যাবে না, ‘ওয়েলকাম টু গ্রামীণ ইউনিক্লো...।’

গ্রামীণ ইউনিক্লোর প্রধান কার্যালয় গুলশানে। আর সচল বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ১০। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেড় শ কর্মী কাজ করেন। কর্তৃপক্ষ হঠাৎ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কর্মীরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা পড়েছেন।

গ্রামীণ ইউনিক্লোতে কর্মরত কয়েক কর্মী বলেছেন, কোনো ধরনের পূর্বাভাস ছাড়াই গত বুধবার কর্তৃপক্ষ প্রধান কার্যালয়ে এক জরুরি বৈঠকে প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়টি কর্মীদের জানায়। পরদিন, অর্থাৎ গত বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দেওয়া হয়। তাঁরা আরও বলেন, হঠাৎ কেন গ্রামীণ ইউনিক্লো বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, সেটি তাঁদের কাছে পরিষ্কার নয়।

নিজেদের ওয়েবসাইটে গ্রামীণ ইউনিক্লো বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানায়, ২০১০ সালে তাদের মূল প্রতিষ্ঠান ফাস্ট রিটেইলিং গ্রামীণ ব্যাংক গ্রুপের সঙ্গে যৌথভাবে পোশাক ব্যবসার মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা, যেমন দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবসা শুরু করে। ২০১৩ সালে ঢাকায় গ্রামীণ ইউনিক্লোর প্রথম বিক্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সেই সঙ্গে ব্যবসায়িক পরিবেশ পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করছি, আমাদের ব্যবসার একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য অর্জন করতে সফল হয়েছি। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আমাদের ব্যবসার কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

অবশ্য গ্রামীণ ইউনিক্লো বন্ধ হলেও ইউনিক্লোর মূল প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট রিটেইলিং বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদন অব্যাহত রাখবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ২০০৮ সালে তারা বাংলাদেশে লিয়াজোঁ কার্যালয় চালু করে। সহযোগী কারখানাগুলো ইউনিক্লোসহ ফাস্ট রিটেইলিংয়ের পোশাক উৎপাদন অব্যাহত থাকবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু গ্রামীণ ইউনিক্লো দেশের ১৩টি কারখানা থেকে পোশাক তৈরি করাত। সেসব কারখানা কর্তৃপক্ষকে ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কোম্পানি বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ব্র্যান্ডটি। এ ছাড়া বর্তমানে চালু থাকা ১০টি বিক্রয়কেন্দ্রের ভবনমালিকের সঙ্গে চুক্তি শেষ করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

জাপানভিত্তিক বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ইউনিক্লোর মূল প্রতিষ্ঠান ফাস্ট রিটেইলিং কোম্পানি। তারা সামাজিক ব্যবসার অংশ হিসেবে গ্রামীণ ইউনিক্লো ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করে। এ জন্য ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমে ইউনিক্লো সোশ্যাল বিজনেস বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পরের বছর জুনে গ্রামীণ ইউনিক্লো লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানি গঠন করা হয়।

প্রথম কোম্পানিতে ফাস্ট রিটেইলিং কোম্পানির শেয়ার শতভাগ। মূলধন ছিল ৪৬ লাখ মার্কিন ডলার। আর দ্বিতীয় কোম্পানি, অর্থাৎ গ্রামীণ ইউনিক্লোতে ফাস্ট রিটেলিংয়ের শেয়ার ৯৯ এবং গ্রামীণ হেলথকেয়ার ট্রাস্টের শেয়ার ১ শতাংশ। এই কোম্পানির মূলধন ছিল ১ লাখ মার্কিন ডলার।

ইউনিক্লো সোশ্যাল বিজনেস বাংলাদেশ লিমিটেড বৃহস্পতিবার গ্রামীণ ইউনিক্লোর ব্যবসা বন্ধের সিদ্ধান্ত জানালেও গত বছরের নভেম্বর থেকে প্রক্রিয়াটি শুরু করে। তারই অংশ হিসেবে গত বছরের নভেম্বর থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত গত ছয় মাসে আটটি বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ করা হয়। তার মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে একসঙ্গে চারটি বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ হয়। বন্ধ হওয়া আটটি বিক্রয়কেন্দ্র ছিল বসুন্ধরা শপিং সিটি, বেইলি রোড, জয়দেবপুর, সাভার, কাঁটাবন, এলিফ্যান্ট রোড, খিলগাঁও এবং নারায়ণগঞ্জে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রামীণ ইউনিক্লোর দুজন কর্মী প্রথম আলোকে জানান, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে নতুন প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ করা হয়। তিনি আসার পরই মূলত কোম্পানি বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

কোম্পানি বন্ধের মূল কারণ জানতে চাইলে গ্রামীণ ইউনিক্লোর বিপণন বিভাগের প্রধান শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ফাস্ট রিটেইলিং কোম্পানি সামাজিক ব্যবসার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে গ্রামীণ ইউনিক্লো ব্র্যান্ড চালু করে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের যে উদ্দেশ্য নিয়ে উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল, তার একটি অংশ ইতিমধ্যে অর্জন হয়েছে। তা ছাড়া দেশের অর্থনীতিতে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সে কারণে ফাস্ট রিটেইলিং কোম্পানি গ্রামীণ ইউনিক্লোর ব্যবসা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বর্তমানে গ্রামীণ ইউনিক্লোর বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে যমুনা ফিউচার পার্ক, গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড, নারায়ণগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সড়ক, সায়েন্স ল্যাব, নরসিংদী, পুরান ঢাকার ওয়ারী, মোহাম্মদপুর রিং রোড, মেট্রো শপিং মল, যাত্রাবাড়ী এবং মিরপুর ১২ এলাকায়।

কোম্পানি বন্ধের সিদ্ধান্তটি কর্মীরা কীভাবে দেখছেন, সে বিষয়ে গ্রামীণ ইউনিক্লোর উপব্যবস্থাপক (গবেষণা ও উন্নয়ন) মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমপ্লায়েন্স ইস্যু দেখিয়ে একের পর এক বিক্রয়কেন্দ্র যখন বন্ধ করা হচ্ছিল, তখন আমরা মনে করেছিলাম, হয়তো ব্যবসা পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে তা করা হচ্ছে। তবে বৃহস্পতিবার আমাদের সঙ্গে বৈঠক করে কর্তৃপক্ষ যে সিদ্ধান্ত জানাল, তার জন্য আমরা সত্যিই প্রস্তুত ছিলাম না।’

মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, ‘ভালো একটা ভবিষ্যতের আশায় আমরা বৈশ্বিক কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলাম। কিন্তু যেভাবে তারা বন্ধ করল, সেটি হতাশাজনক। আমাদের আরও কিছুটা সময় দেওয়া উচিত ছিল।’

এদিকে গ্রামীণ ইউনিক্লোর ব্যবসা বন্ধের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ইউনূস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোর্শেদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ইউনিক্লোর মতো জনপ্রিয় বৈশ্বিক কোম্পানি সামাজিক ব্যবসায় সফল হয়েছে, তাতে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। তবে ব্যাপক সফলতা অর্জনের পরও তারা ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে, বিষয়টি দুঃখজনক। আমরা দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছি।’

জাপানে ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত ফাস্ট রিটেইলিং কোম্পানির ইউনিক্লো ছাড়াও জিইউ, থিওরি, প্রিন্সেস টমটমসহ কয়েকটি পোশাকের ব্র্যান্ড রয়েছে। জাপান, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫৯২। গত ৩১ আগস্ট শেষ হওয়া অর্থবছরে ফাস্ট রিটেইলিংয়ের আয় ছিল ১ হাজার ৭০৮ কোটি ডলার। এ সময় তাদের কর–পূর্ববর্তী মুনাফা ছিল ৩০৭ কোটি ডলার।

ব্যবসা বন্ধের প্রক্রিয়া হিসেবে কয়েক দিন ধরে গ্রামীণ ইউনিক্লোর অধিকাংশ পোশাকে মূল্যছাড় চলছে। এ বিষয়ে শরিফুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে যে মূল্যছাড় চলছে, সেটি অন্যান্য সময়ের মতোই স্বাভাবিক। কারণ, ক্রেতাদের আমরা সব সময়ই নতুন কিছু দেওয়ার চেষ্টা করে থাকি। তবে ব্যবসা বন্ধের প্রক্রিয়া হিসেবে পণ্যের স্টক শেষ করতে শিগগিরই বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।