বেকারি থেকে বিস্কুট এখন করপোরেটে

দেশে বিস্কুটের বাজারের আকার ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। গড়ে উঠেছে বিস্কুটের বাংলাদেশি ব্র্যান্ড, যা ছড়িয়ে পড়ছে বিদেশেও।

বিস্কুটের বড় বাজার আকৃষ্ট করছে বড় প্রতিষ্ঠানকে। তাদের প্রতিষ্ঠিত কারখানায় স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় তৈরি হয় বিস্কুট
সংগৃহীত

দেশে একসময় বিস্কুট তৈরি করত পাড়া-মহল্লার বেকারিগুলো। ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস বই বলছে, ১৯৬৪ সালে ঢাকা জেলায় ১৯টি বেকারি ছিল। এখন অবশ্য চিত্রটি ভিন্ন, করপোরেট বিনিয়োগে তৈরি হয়েছে বিস্কুটের বাংলাদেশি ব্র্যান্ড। সেই ব্র্যান্ড শুধু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েনি, বিদেশের বাজারেও ভালো করছে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে বিস্কুটের বাজারের আকার ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। মানে হলো, বছরে এই পরিমাণ টাকার বিস্কুট কেনাবেচা হয়। বিশাল বাজার দেখে বড়রা আকৃষ্ট হয়েছে। বেশ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান এ খাতে বড় বিনিয়োগ করেছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই এ খাতে ছিল। তারা ব্যবসা সম্প্রসারণ করে বড় হয়েছে।

বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএবিবিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ছোট-বড় পাঁচ থেকে ছয় হাজার প্রতিষ্ঠান বিস্কুট উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে ১০০টির মতো প্রতিষ্ঠানের স্বয়ংক্রিয় কারখানা রয়েছে। ৫০টি মাঝারি আকৃতির, ৩৫টির মতো কারখানা বড় হিসেবে গণ্য হয়। বৃহৎ শিল্প বলতে যা বোঝায়, বিস্কুটের তেমন কারখানা রয়েছে ১৫টির মতো।

করপোরেট বিনিয়োগের ফলে বিস্কুটে বৈচিত্র্য এসেছে, স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে উৎপাদন নিশ্চিত হয়েছে এবং আমদানির বিকল্প বিস্কুট উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
শফিকুর রহমান ভূঁইয়া, বাংলাদেশ অটো-বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি

বড় বিনিয়োগ ও পণ্য নিয়ে গবেষণার ফল হিসেবে বিস্কুটের স্বাদ ও ধরনে বৈচিত্র্য এসেছে। কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তির কারণে তুলনামূলক কম দামে ও শ্রমে মানসম্মত বিস্কুট উৎপাদন সহজ হয়েছে। এতে আমদানি–নির্ভরতাও কমেছে।

বাংলাদেশ অটো-বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, করপোরেট বিনিয়োগের ফলে বিস্কুটে বৈচিত্র্য এসেছে, স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে উৎপাদন নিশ্চিত হয়েছে এবং আমদানির বিকল্প বিস্কুট উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশের বিস্কুট বিদেশে রপ্তানি হয়।

স্বাধীনতার আগে ও এখন

মোটাদাগে দেশের খাদ্যশিল্পের একটি অংশ হলো বিস্কুট শিল্প বা বিস্কুটের কারখানা। দেশ স্বাধীনের আগে এই অঞ্চলে মোট কয়টি বিস্কুটের কারখানা ছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের বিস্কুট উৎপাদনকারী দুটি পুরোনো প্রতিষ্ঠান হক ও নাবিস্কো।

ব্যারিস্টার তমিজুল হক ১৯৪৭ সালে ঢাকার তেজগাঁওয়ে বিস্কুটের কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠানটি এখনো বাজারের অন্যতম হিস্যাধারী। আর নাবিস্কোও স্বাধীনতার আগ থেকে বিস্কুট উৎপাদন করছে। এরপর বিস্কুট উৎপাদনে যুক্ত হয় মাসাফি, আজাদ নামে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

করোনার সময় বিস্কুটের বাজারে প্রবৃদ্ধি ছিল ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। করোনার বিধিনিষেধ শিথিল করার পর এই খাতে প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করে। এখন এটি ৬ থেকে ৮ শতাংশ। তিনি বলেন, প্রতিদিনই বিস্কুটের নতুন নতুন ভোক্তা তৈরি হয়, তাই চাহিদা কমবে না।
রেজাউল করিম, রিদিশা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

বিস্কুট খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিস্কুটের বাজারটি মোটাদাগে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত-বেকারিতে তৈরি বিস্কুট, ছোট ছোট অঞ্চল বা এলাকাভিত্তিক ব্র্যান্ডের বিস্কুট এবং প্রতিষ্ঠিত বড় কোম্পানির কারখানায় উৎপাদিত বিস্কুট।

ব্র্যান্ডের বিস্কুটের দাম আগের চেয়ে কমে আসায় সেগুলোর বিক্রি প্রতিবছরই বাড়ছে। অলিম্পিক, হক, নাবিস্কো, ড্যানিশ, রোমানিয়া, কোকোলা, প্রাণ, কিষোয়ান, ওয়েল ফুড, রিদিশা, আকিজ, ফ্রেশ, ড্যান ফুডস, ইস্পাহানি—এগুলোই বিস্কুটের বাজারে এখন বড় ব্র্যান্ড।

বিস্কুট খাতে সাম্প্রতিক বড় বিনিয়োগকারী আকিজ ও রিদিশা। ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে বিস্কুট উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের শিল্পগোষ্ঠী আকিজ ইনসাফ গ্রুপ। এ জন্য ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে আকিজ বেকার্স লিমিটেড নামের নতুন প্রতিষ্ঠান গড়েছে তারা। এর আগে ২০১৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎপাদনে আসে রিদিশা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড।

কুকিজ আর বিস্কুটের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। বিস্কুট মচমচে ও হালকা হয়। আর কুকিজ তুলনামূলকভাবে নরম, মুখে দিলে গলে যায়, স্বাদও ভিন্ন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ডেনমার্কের রেসিপি ব্যবহার করে উৎপাদন করা কুকিজ উন্নত মানের।
শাহীদ বিন সারোয়ার, প্রতিষ্ঠানটির বিপণন বিভাগের প্রধান (হেড অব মার্কেটিং)

বাজার আরও বড় হচ্ছে

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিও কিছুটা চাপে আছে, যার ছাপ পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। বিস্কুটের উপকরণের দামও বেড়েছে ব্যাপকভাবে। ফলে বিস্কুটের বাজারের গতি কিছুটা কমে গেছে।

রিদিশা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সময় বিস্কুটের বাজারে প্রবৃদ্ধি ছিল ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। করোনার বিধিনিষেধ শিথিল করার পর এই খাতে প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করে। এখন এটি ৬ থেকে ৮ শতাংশ। তিনি বলেন, প্রতিদিনই বিস্কুটের নতুন নতুন ভোক্তা তৈরি হয়, তাই চাহিদা কমবে না।

করোনাকালে অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ওই সময় বিস্কুটকে মানুষ স্বাস্থ্যকর বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছিল।

বিস্কুটে বৈচিত্র্য

শিশু থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ সবার কাছেই কমবেশি প্রিয় বিস্কুট। কিন্তু নানা বয়সী ও নানা ধরনের ভোক্তার চাহিদাও ভিন্ন। তাঁদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে বিস্কুট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও পণ্যে নানা বৈচিত্র্য এনেছে। ফলে বাজারে মিলছে নানা দাম ও স্বাদের বৈচিত্র্যময় বিস্কুট।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুই শতাধিক রকমের বিস্কুট আছে। এগুলোর স্বাদও ভিন্ন। এর মধ্যে চকলেট, আলু, জিরা, ক্রিম, মসলা, নোনতা, বাদাম, দুধ, ঘি, ঝাল, সবজি, গ্লুকোজ, কফি, স্ট্রবেরি, কমলার মতো স্বাদগুলো অন্যতম। এ ছাড়া ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য চিনি ছাড়া বিস্কুট এবং হজমসহায়ক ‘ডাইজেস্টিভ’ বিস্কুটও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের জন্য বিভিন্ন ধরনের কুকিজ তৈরি করছে বিস্কুট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

ডেনমার্কের ড্যান কেক এ/এস ও বাংলাদেশের পাণ্ডুঘর গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে ২০১৫ সালে দেশে যাত্রা শুরু করে ড্যান ফুডস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি মূলত কেক ও কুকিজ উৎপাদন করে। ড্যান কেক ব্র্যান্ডের আওতায় ২৭ ধরনের কেক ও চার ধরনের কুকিজ পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটির বিপণন বিভাগের প্রধান (হেড অব মার্কেটিং) শাহীদ বিন সারোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, কুকিজ আর বিস্কুটের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। বিস্কুট মচমচে ও হালকা হয়। আর কুকিজ তুলনামূলকভাবে নরম, মুখে দিলে গলে যায়, স্বাদও ভিন্ন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ডেনমার্কের রেসিপি ব্যবহার করে উৎপাদন করা কুকিজ উন্নত মানের।

আমদানিনির্ভরতা কমেছে

একসময় দেশে প্রচুর বিস্কুট আমদানি হতো। কিন্তু দেশে বড় কোম্পানির বিনিয়োগ এবং বিদেশি বিস্কুটের ওপর শুল্কারোপের কারণে আমদানিনির্ভরতা কমেছে।

উদাহরণ লেক্সাস বিস্কুট। এটি মূলত একধরনের ‘ভেজিটেবল ক্র্যাকার্স’, যা মালয়েশিয়া থেকে আমদানি হতো। এখন এই বিস্কুট দেশেই উৎপাদিত হয়। অন্তত চারটি প্রতিষ্ঠান লেক্সাস বিস্কুট উৎপাদন করে।

বড়দের বিনিয়োগের কারণে একটি সমস্যা হলো, স্থানীয় পর্যায়ের ছোট বেকারিগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যারা টিকে আছে, তারা বড়দের সঙ্গে কোনোভাবেই প্রতিযোগিতায় পারছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ছোটদের টিকে থাকতে হলে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বিস্কুট উৎপাদন করতে হবে। পাশাপাশি ছোটদের জন্য সরকারের বিশেষ নীতিসহায়তা থাকা দরকার।

বাংলাদেশ অটো-বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বললেন, ছোটদের টিকে থাকার একটি উপায় হতে পারে বড় ব্র্যান্ডের জন্য চুক্তিভিত্তিতে পণ্য উৎপাদন।