দেশের ঘরে ঘরে দেশি ফ্রিজ

বাসাবাড়িতে রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজের ব্যবহার এখন সাধারণ বিষয়। শুধু শহর এলাকা নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও ফ্রিজের ব্যবহার বাড়ছে। যদিও আগে চিত্রটি এমন ছিল না। তখন আমদানিনির্ভর গৃহস্থালি সরঞ্জামটির দাম ছিল অনেক বেশি; ব্যবহারও ছিল সীমিত। তবে গত দেড় দশকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে দেশে উৎপাদিত ফ্রিজ।

বর্তমানে সারা বছর দেশে যে পরিমাণ ফ্রিজ বিক্রি হয়, তার অধিকাংশই দেশে উৎপাদিত। বাকিটা আমদানি করা। রাজধানীতে গত মে মাসে এক অনুষ্ঠানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশে বর্তমানে ৯০ শতাংশ ফ্রিজ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে। সরকারের নীতিসহায়তা ও অনুকূল শুল্ক কাঠামো থাকায় এমনটা সম্ভব হয়েছে।

দেশে ফ্রিজ উৎপাদনের ইতিহাস খুব পুরোনো নয়। ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম উৎপাদনকারী কোম্পানি সূত্র বলছে, দেশীয় কোম্পানি ওয়ালটন দেশে প্রথম ফ্রিজ উৎপাদন শুরু করে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে নিজস্ব কারখানায় ওয়ালটনের ফ্রিজের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০০৮ সালে।

এরপর একে একে মিনিস্টার, যমুনা, প্রাণ-আরএফএল, ট্রান্সকম ও ওরিয়নের মতো দেশীয় কোম্পানিগুলো কারখানা স্থাপন করে। পাশাপাশি স্যামসাং, সিঙ্গার, ওয়ার্লপুল, সনি-স্মার্ট ও কনকার মতো বিদেশি ব্র্যান্ডের কারখানাও গড়ে উঠেছে দেশে।

ইলেকট্রনিকস খাতে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছে সরকার।

ওয়ালটন রেফ্রিজারেটরের প্রধান ব্যবসায়িক কর্মকর্তা বা চিফ বিজনেস অফিসার (সিবিও) তাহসিনুল হক প্রথম আলোকে বলেন,
সরকারের উদ্দেশ্য ছিল ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীল হওয়া। ফলে সরকারের নীতিসহায়তা নিয়ে দেশীয় কোম্পানিগুলো ফ্রিজের বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে।

ব্যবহার বাড়ছে ফ্রিজের

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদনে (২০২৩) বলা হয়েছে, দেশে মোট পরিবার বা খানার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে ৫৩ দশমিক ৪০ শতাংশ পরিবারে অন্তত একটি ফ্রিজ রয়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল ৪৫-এর কিছু বেশি।

স্থানীয়ভাবে ফ্রিজ উৎপাদনের কারণেই এমন পরিস্থিতি সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন ট্রান্সকম ডিজিটালের ফ্রিজ ও অন্যান্য অ্যাপ্লায়েন্স বিভাগের প্রধান সৈকত আজাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ধরনের মূল্য সংযোজন ছাড়া আমদানি করে গ্রাহকের কাছে প্রতিযোগিতামূলক দামে ফ্রিজ পৌঁছানো সম্ভব নয়। এ কারণে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোও স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বা সংযোজনে মনোযোগী হচ্ছে।

বড় বাজার

দেশের ফ্রিজের বাজার নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। জার্মানিভিত্তিক বাজার গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা ডট কমের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ফ্রিজের বাজার ছিল ১৫৩ কোটি ডলারের বা প্রায় ১২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার। ছয় বছরের ব্যবধানে বর্তমানে সেই বাজার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৩০ কোটি ডলারে (প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা)। স্ট্যাটিস্টা বলছে, ২০২৯ সাল নাগাদ ফ্রিজের দেশীয় বাজার ২৯৬ কোটি ডলারে (বর্তমান মূল্যে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা) পৌঁছাতে পারে।

 স্ট্যাটিস্টার হিসাবে বাসাবাড়ির পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পে ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত ফ্রিজ ও কুলার-জাতীয় যন্ত্রকে ধরা হয়েছে। খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে বর্তমানে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত ফ্রিজের বাজার আনুমানিক ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার।

স্ট্যাটিস্টার হিসাব বলছে, গত বছর দেশে ৩২ লাখ ইউনিট ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে। পাঁচ বছর আগে বিক্রির সংখ্যাটি ছিল ২৬ লাখ। অর্থাৎ ফ্রিজ বিক্রির সংখ্যা ও অর্থমূল্যে বাজারের আকার—দুটিই উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।

খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হিসাবে, প্রতিবছর দেশে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে ফ্রিজের বাজার বাড়ছে।

যত ব্র্যান্ড রয়েছে

ফ্রিজ উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফ্রিজের বাজারে ১০টির বেশি দেশীয় ব্র্যান্ড রয়েছে—ওয়ালটন, মার্সেল, মিনিস্টার, মাই ওয়ান, যমুনা, ট্রান্সটেক, ভিশন, ইলেকট্রা, র‍্যাংগস, ওরিয়ন, হাইকো, স্মার্ট, ইকো প্লাস প্রভৃতি। আর দেশে উৎপাদিত ও সংযোজিত বিদেশি ব্র্যান্ডের ফ্রিজের মধ্যে রয়েছে সিঙ্গার, স্যামসাং, কনকা, এলজি, ওয়ার্লপুল, হায়ার, হিটাচি, হাইসেন্স প্রভৃতি।

অন্যদিকে শার্প, প্যানাসনিক, সিমেন্স ইত্যাদি ব্র্যান্ডের ফ্রিজও দেশের বাজারে বিক্রি হয়। যেসব কোম্পানি এখন সংযোজন করছে, তারাও ভবিষ্যতে যন্ত্রাংশ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।

যেসব চ্যালেঞ্জ

কোম্পানিগুলো বলছে, তাদের মূল সমস্যা এখন মার্কিন ডলারের সংকট, মূল্যবৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি। উৎপাদন খরচ বাড়ায় ভুগেছে দেশি-বিদেশি সব কোম্পানি।

ইলেকট্রো মার্টের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) নুরুল আফছার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা বেশ চাপের মধ্যে ব্যবসা করে যাচ্ছি। সম্প্রতি ডলারের দর বেড়ে ১১৭ টাকা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি পেয়ে
প্রায় ১৩-১৪ শতাংশে পৌঁছেছে। এই পরিস্থিতি দেশে ফ্রিজের বাজারবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করছে।’