অলংকার কিনলে মজুরি নেই, ডায়মন্ডেও আছে মূল্যছাড়

তিন দিনের এ মেলায় ৫০টি প্যাভিলিয়ন, মিনি প্যাভিলিয়ন ও স্টলে জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি জুয়েলারিশিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী কোম্পানি অংশ নিয়েছে।

সোনার অলংকার মেলা উদ্বোধনের পর মেলায় অলংকার দেখছেন এক দর্শনার্থী। গতকাল ঢাকার আইসিসিবিতে।
ছবি: প্রথম আলো

সারি সারি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের স্টল। থরে থরে সাজানো সোনার অলংকার। কোনো কোনোটিতে আছে ডায়মন্ডের অলংকার। সোনার তৈরি কানের দুল থেকে শুরু করে আংটি, ব্রেসলেট, চুড়ি, গলার চেইন, সীতাহার, টিকলি, ঘড়ি—সবই মিলছে এক ছাদের নিচে।

রাজধানীর পূর্বাচল এক্সপ্রেস হাইওয়ে-সংলগ্ন ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার (আইসিসিবি) নবরাত্রী হলে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় সোনার অলংকারের মেলায় ঢুকতেই ‘স্বর্ণময় অভ্যর্থনা’ মিলল। তখনো মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়নি। কিছু স্টলে সাজসজ্জার কাজ চলছিল। তাতে কী, নারী দর্শনার্থীরা ততক্ষণে ঢুঁ দিতে শুরু করেছেন জুয়েলারি দোকানে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির বা বাজুসের আয়োজনে তিন দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীর পোশাকি নাম ‘বাজুস ফেয়ার-২০২৩’। এতে ৫০টি প্যাভিলিয়ন, মিনি প্যাভিলিয়ন ও স্টলে জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি জুয়েলারিশিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী কোম্পানি অংশ নিয়েছে। মেলার উদ্বোধন করেন জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি সায়েম সোবহান।

‘বাংলাদেশের জুয়েলারিশিল্প কতটা এগিয়েছে, সেটি আমরা মেলার মাধ্যমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি। প্রথম দিনে ক্রেতা-দর্শনার্থীর উপস্থিতি খারাপ হয়নি। সকালের দিকে কিছুটা কম থাকলেও বিকেলে ভিড় বেড়েছে।’
আমিনুল ইসলাম, জুয়েলার্স সমিতির সহসভাপতি দেওয়ান

বিশ্ববাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় দেশের বাজারে আরও দামি হয়ে উঠেছে সোনার অলংকার। বর্তমানে হলমার্ক করা ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার অলংকার কিনতে লাগছে ৯২ হাজার ২৬২ টাকা। গত মাসেও দাম ছিল ৯৩ হাজার ৪২৯ টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

মেলায় অংশ নেওয়া কয়েকজন ব্যবসায়ী জানালেন, সোনার দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমে গেছে। নতুন কেনার বদলে পুরোনো অলংকার বিক্রির প্রবণতা বেড়েছে। ব্যতিক্রম তথ্যও দিলেন একাধিক ব্যবসায়ী। তাঁরা বললেন, সোনার দাম যখন বাড়তে থাকে, তখন আরও বাড়বে, এমন আশঙ্কা থেকে একশ্রেণির ক্রেতা অলংকার কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তাতে বিক্রি বাড়ে। তবে দাম ওঠানামার মধ্যে থাকলে অলংকার বিক্রিতে মন্দা যায়।

জুয়েলারি খাতে দেশের পরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর একটি ভেনাস জুয়েলার্স মেলায় অংশ নিয়েছে। তাদের প্যাভিলিয়নে গলার হার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সোনার অলংকার প্রদর্শন করা হচ্ছে। মেলায় তারা অলংকার প্রদর্শনী, বিক্রি—এমনকি নতুন অলংকার তৈরির ক্রয়াদেশ নিচ্ছে। মেলা উপলক্ষে অলংকার তৈরির মজুরিতে ছাড় দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

ব্যবসার পরিস্থিতি কেমন, জানতে চাইলে ভেনাস জুয়েলার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিধান মালাকার বলেন, আগে বিয়েশাদির সময় বর ও কনে দুই পক্ষই আলাদা করে সোনার অলংকার কিনত। সোনার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বর ও কনেপক্ষ একসঙ্গে মিলে অলংকার কেনেন।

আশির দশকে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে ব্যবসা শুরু করেছিল ভিনায়েক গোল্ড অ্যান্ড ডায়মন্ড গার্ডেন। বর্তমানে তাদের বসুন্ধরা সিটি শপিং মল ও যমুনা ফিউচার পার্কেও দুটি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সোনার পাশাপাশি ডায়মন্ডের অলংকারও বিক্রি করে।

প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী সুমন কর্মকার জানান, মেলায় অলংকার কিনলে ক্রেতাদের মজুরি দিতে হবে না। ডায়মন্ডের অলংকারে ৩৫ শতাংশ মূল্যছাড় দিচ্ছি। আবার ৫০ হাজার টাকার বেশি অলংকার কিনলে ক্যাশব্যাকসহ বিভিন্ন উপহারও রয়েছে ক্রেতাদের জন্য।

দেশের আরেক পরিচিত ব্র্যান্ড সুলতানা জুয়েলার্সও মেলায় অংশ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক রাজীব ইকবাল জানান, সোনার দাম আকাশচুম্বী হওয়ার কারণে ক্রেতাদের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে নারীদের কাছে ওজনে হালকা, এমন অলংকার বেশি জনপ্রিয়। আগের মতো ভারী অলংকারের বিক্রি এখন আর নেই। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সোনার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশে সোনার অলংকারের বাজার ছোট হয়ে গেছে। তবে সময় এসেছে সোনার অলংকার রপ্তানির। দুই একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করলে বাকিরাও পথের সন্ধান পাবে।

ডিজিটাল পদ্ধতিতে সোনা পরিমাপ, অলংকারের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা, লেজার কাটিংসহ বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে মেলায় অংশ নিয়েছে চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে একটি ড্রিমস ইনস্ট্রুমেন্ট টেকনোলজি। তারা যুক্তরাষ্ট্রের স্কাইরে ব্র্যান্ডের যন্ত্রপাতি দেশে বিক্রি করে।

প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং শ্রীকান্ত সাহা জানান, সোনার অলংকার বা সোনা ওজনের ডিজিটাল মেশিনের দাম ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। আবার লেজার কাটিং মেশিন বিক্রি করছেন ১৫ লাখ টাকায়। সোনার অলংকারের বিশুদ্ধতা পরিমাপের যন্ত্রের দাম ১৩ লাখ টাকা। তিনি জানান, দেশের জুয়েলারিশিল্পে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ছে। ইতিমধ্যে তাঁরা সোনার বিশুদ্ধতা পরিমাপের ২০০টি ডিজিটাল যন্ত্র বিক্রি করেছেন।

অলংকারের পাশাপাশি নিত্যব্যবহার্য, যেমন সোনার হাতঘড়ি নিয়ে এসেছে জায়া গোল্ডেন অ্যান্ড ডায়মন্ড। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা সজীব কর্মকার বললেন, মেলায় প্রদর্শন করা ঘড়িটি আমদানি করা। তবে বাংলাদেশের কারিগরেরা যেকোনো ঘড়ির বেল্ট তৈরির সক্ষমতা রাখেন। আধুনিক যন্ত্রপাতি, নকশা আর প্রশিক্ষণ দিলে দেশের কারিগরেরা রপ্তানিযোগ্য অলংকার তৈরি করতে পারবেন।

জানতে চাইলে জুয়েলার্স সমিতির সহসভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জুয়েলারিশিল্প কতটা এগিয়েছে, সেটি আমরা মেলার মাধ্যমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি। প্রথম দিনে ক্রেতা-দর্শনার্থীর উপস্থিতি খারাপ হয়নি। সকালের দিকে কিছুটা কম থাকলেও বিকেলে ভিড় বেড়েছে।’