পরিবেশবান্ধব কারখানা
সুফল পেতে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ
সিপিডির সংলাপে বলা হয়, পরিবেশবান্ধব কারখানার বিষয়ে শিল্পমালিক, সরকার, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
দেশের তৈরি পোশাক খাতের ৮০ শতাংশ মালিক ও ব্যবস্থাপকের মতে, ‘পরিবেশবান্ধব’ উপায়ে কারখানায় পণ্য তৈরি করলে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। কর্মীরা আরও মনে করেন, কারখানায় ‘পরিবেশবান্ধব’ চর্চার কারণে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ও চিকিৎসা ব্যয় কমে ও উৎপাদনশীলতা বাড়ে।
তবে পরিবেশবান্ধব কারখানার কোনো সর্বজনীন মানদণ্ড নেই। ক্রেতা ভেদে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংজ্ঞা আলাদা, সনদও রয়েছে অনেক ধরনের। এসব কারণে ক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্যের ভালো দাম পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। সে জন্য পরিবেশবান্ধব টেকসই কারখানার বিষয়ে শিল্পমালিক, সরকার, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
বাস্তবতায় কারখানাকে পরিবেশবান্ধব করতে ভারসাম্যমূলক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে তৈরি পণ্যের জন্য ক্রেতাদেরও উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করা উচিত।
গতকাল মঙ্গলবার বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সংলাপে গবেষক, কূটনীতিক ও অংশীজনেরা এমন মতামত দেন। রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত এ সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম।
সংলাপে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের পরিবেশবান্ধব রূপান্তর বিষয়ে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা ফেলো মুনতাসির কামাল। দুই খাতের ৪০৩টি কারখানার তথ্য ও ৪ হাজার ৫৪১ জন কর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, কীভাবে পরিবেশবান্ধব সনদ পাওয়া যায়, এ বিষয়ে সাড়ে ১৭ শতাংশ কারখানার স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। বড় কারখানাগুলোর প্রায় ৮১ শতাংশ সনদের বিষয়ে জানলেও মাঝারি ও ছোট পর্যায়ের ১৫ শতাংশ এবং অতিক্ষুদ্র পর্যায়ের মাত্র ৩ শতাংশ কারখানা বিষয়টি জানে।
বিভিন্ন সংস্থার থেকে পরিবেশবান্ধব সনদ পাওয়া বেশ কিছু কারখানার তথ্য গবেষণায় নেওয়া হয়েছে। তাদের ৮০ শতাংশ জানিয়েছে, স্বপ্রণোদিত হয়েই তারা কারখানার পরিবেশবান্ধব রূপান্তর করেছে। তবে একই সঙ্গে ক্রেতাদের চাহিদা, টেকসই চর্চা, আরও প্রতিযোগিতামূলক হওয়া এবং বাজার কৌশলও প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কারখানাকে পরিবেশবান্ধব করার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন এ ধরনের কারখানা তৈরিতে সহজে ঋণ না পাওয়াই বড় সমস্যা। এসব কারখানা পরিচালনার জন্য দক্ষ মানবসম্পদেরও অভাব রয়েছে। আবার স্থানীয় বাজারে এসব পণ্যের চাহিদা কম থাকাও আরেক চ্যালেঞ্জ।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, বর্তমানে পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদনের জন্য যে চাপ রয়েছে, দেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সেই চাপ আরও বাড়বে। দেশের অনেক কারখানা ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রিন সনদ নিয়েছে। কিন্তু ‘গ্রিন কারখানার’ বিষয়ে পোশাকের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বস্বীকৃত কোনো মানদণ্ড নেই। এ বিষয়ে প্রত্যেকের চাহিদা ও সংজ্ঞা আলাদা। ফলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এ জন্য উদ্যোক্তা, সরকার, ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো মিলে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) পরিবেশবান্ধব কারখানার তালিকায় বিশ্বের শীর্ষ ১৫ পরিবেশবান্ধব কারখানার ১৩টিই বাংলাদেশের। তবে দেশের মোট কারখানার তুলনায় পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা এখনো অনেক কম বলে জানান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। তিনি বলেন, পরিবেশবান্ধব কারখানার জন্য সরকার ইতিমধ্যে বন্ডেড ওয়্যারহাউসসহ বিভিন্ন সহায়তা দিচ্ছে। ক্রেতারা পরিবেশবান্ধব কারখানায় তৈরি সেরা পণ্যের জন্য অতিরিক্ত দাম দিলে তা বড় সহায়তা হবে।
বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের উপপ্রধান থিজ উডস্ট্রা বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের সামনে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ দুটোই একই সঙ্গে দেখা দেবে। এমন বাস্তবতায় কারখানাকে পরিবেশবান্ধব করতে ভারসাম্যমূলক উদ্যোগ নিতে হবে। আবার পরিবেশবান্ধব উপায়ে তৈরি পণ্যের জন্য ক্রেতাদেরও উপযুক্ত মূল্য দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দ্রা বার্গ ভন লিন্ডে বলেন, পরিবেশবান্ধব কারখানায় রূপান্তরের বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ, প্রয়োজনীয় দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং নীতি, প্রযুক্তি ও আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা দরকার।
বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, পোশাক ও বস্ত্র খাতে পরিবেশবান্ধব পরিবর্তন এখন ঐচ্ছিক বিষয় নয়, বরং প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে দেশের অন্যান্য খাতেও পরিবেশবান্ধব রূপান্তরের ওপর জোর দিতে হবে।