শতবর্ষী ডালশিল্প এখন চরম অস্তিত্বসংকটে

বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীগুলো ডাল আমদানি করে স্বয়ংক্রিয় কারখানায় ভাঙিয়ে তা বাজারজাত করায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না।

মসুর ডাল
ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জের শতবর্ষী ডালশিল্প এখন অস্তিত্বসংকটে। লোকসানের কারণে গত পাঁচ বছরে এখানকার ৮৫ শতাংশ ডাল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন পাঁচ–ছয় হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। বর্তমানে যেগুলো টিকে আছে, সেগুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বলে দাবি মালিকদের।

ডালকলের মালিকেরা বলছেন, তাঁরা চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে ট্রাক ও নৌপথে আনা ডাল ভাঙিয়ে (ক্র্যাশিং) বাজারজাত করেন। অন্যদিকে দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীগুলো ডাল আমদানি করে বড় বড় স্বয়ংক্রিয় কারখানায় ভাঙিয়ে বাজারজাত করছে। যে কারণে তারা বড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারছেন না। তাই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ একসময় তারাই সারা দেশে ডাল সরবরাহ করতেন। ডালকলের মালিকদের দাবি, সরকার ক্ষুদ্র ডালশিল্প টিকিয়ে রাখতে বিশেষ উদ্যোগ নিলেই কেবল তাঁরা টিকতে পারবেন, না হলে নিজেদের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তাঁরা।

দেশে আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, চিনি, লবণ ও গোখাদ্যের পাশাপাশি ডালেরও পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র নিতাইগঞ্জ। এর মধ্যে ডালের ব্যবসা ১০০ বছরের পুরোনো। একসময় সেখানে ডালের ৩৫টি মিল গড়ে উঠেছিল। এসব কারখানা আমদানি করা ডাবলি, মসুর ও ছোলার ডাল ভাঙিয়ে (ক্র্যাশিং) সারা দেশে সরবরাহ করত। কিন্তু বর্তমানে টিকে আছে মাত্র গোটা পাঁচেক কারখানা। ফলে নিতাইগঞ্জে ডালের রমরমা ব্যবসা এখন আর নেই।

সরকার বড় বড় কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য কিনে সারা দেশে টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে বিতরণ করছে। এসব পণ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে করা হলে তাঁদের উপকার হতো।
বিকাশ চন্দ্র সাহা, সহসভাপতি, জেলা ডাল মিল মালিক সমিতি, নারায়ণগঞ্জ

নিতাইগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, চট্টগ্রাম থেকে আস্ত ডাল কিনতে ও সেখান থেকে নিতাইগঞ্জের কারখানা পর্যন্ত তা আনতে তাঁদের খরচ এমনিতেই বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর চেয়ে বেশি পড়ে। এর ওপর প্রতিনিয়ত ডালের মূল্যবৃদ্ধিতে তাঁরা আরও বিপাকে পড়েন। যেমন বর্তমানে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি ডাবলি ৫৯ টাকা পড়ে, যা ৬ মাস আগে ছিল ৪৩ টাকা।

একইভাবে ৬ মাস আগের ৭০ টাকা কেজির মসুর ডাল এখন ৮৩ টাকা, ৫৬ টাকার ছোলার ডাল ৬২ টাকা। কারখানায় ক্র্যাশ (ভাঙাতে) করতে প্রতি কেজি ডাবলিতে ৪০ পয়সা, মসুরে ১ টাকা ২০ পয়সা, ছোলায় ১ টাকা ৪০ পয়সা খরচ হয়। ক্র্যাশিংয়ের পরে ডাল বাছাই করতে শর্টিং মিলে পাঠানো হয়। সেখানে প্রতি কেজি মসুরে ৮০ পয়সা, ছোলায় এক টাকা করে খরচ হয়। শ্রমিক খরচ তো আছেই। সব মিলিয়ে তাঁরা আর কুলিয়ে উঠছেন না বলে জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লোকসানে পড়ে নিতাইগঞ্জে ইতিমধ্যে কনক ট্রেডার্স, মা কালী ডাল মিল, সিটি ডাল মিল, জগন্নাথ ডাল মিল, আলী ডাল মিল, রহিম ডাল মিল ও লোকনাথ ডাল মিলসহ প্রায় ৩০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

মা সিদ্ধেশরী ডাল মিলের মালিক তপন কুমার সাহা প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের মিলে প্রতিদিন গোটা ডাল ক্র্যাশিংয়ের ক্ষমতা ৬০ টন। তা চালু থাকলেও নিয়মিত লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাঁর অভিযোগ, বড় কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে বাজারে দর নিয়ন্ত্রণ করে। এতে ছোট মিলমালিকেরা বেকায়দায় পড়েন। বড় কোম্পানির কারসাজিতে ছোট মিলমালিকেরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন।

বড় কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে বাজারে দর নিয়ন্ত্রণ করে। এতে ছোট মিলমালিকেরা বেকায়দায় পড়েন। বড় কোম্পানির কারসাজিতে ছোট মিলমালিকেরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন।
তপন কুমার সাহা, মালিক, মা সিদ্ধেশ্বরী ডাল মিল

সিদ্ধেশ্বরী ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক পংকজ সাহা বলেন, বেচাকেনা খুব খারাপ। বাজার স্থিতিশীল না থাকায় মিলমালিকদের প্রতিনিয়ত লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। মূলত বড় গ্রুপগুলো সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করায় ছোট ব্যবসায়ীরা পেরে উঠছেন না।

মদন মোহন ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক বিপ্লব সাহা জানান, লোকসানের কারণে গত এক বছর তাঁদের মিল বন্ধ। তিনি বলেন, মাল উৎপাদন করে লোকসান গুনতে হলে মিল চালিয়ে লাভ কী?

শ্রমিক সরদার রিপন মিয়া জানান, নিতাইগঞ্জে একজন ডাল মিলের শ্রমিক বছরখানেক আগেও প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা আয় করতেন। এখন তা কমে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় নেমেছে। বেকার হয়ে অনেক শ্রমিক গ্রামের বাড়িতে কিংবা অন্য পেশায় চলে গেছেন।

আজমেরী ডাল মিলের ব্যবস্থাপক বাদল জম্মাদার প্রথম আলোকে বলেন, বড় গ্রুপগুলোর পুঁজি বেশি হওয়ায় তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের সঙ্গে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পেরে উঠছেন না। কারণ, তাঁদের পুঁজি ও মাল আমদানির পরিমাণ বেশি, আবার উৎপাদন খরচ কম। অন্যদিকে আমাদের পুঁজি কম, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে।

বাসনা এন্টারপ্রাইজের অঞ্জন সাহা বলেন, নিতাইগঞ্জের ডালের ব্যবসা ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। ডাল ব্যবসার অস্তিত্ব ধ্বংসের মুখে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা ডাল মিল মালিক সমিতির সহসভাপতি বিকাশ চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, গত পাঁচ–সাত বছরে বড় কোম্পানিগুলো ডালের ব্যবসায়ে জড়িত হওয়ায় ক্ষুদ্র মিলমালিক ও ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। অনেক মিলমালিক ও ব্যবসায়ী অব্যাহত লোকসানের মুখে ও ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে মিল বন্ধ করেছেন। কেউ কেউ দেশত্যাগেও বাধ্য হয়েছেন।

বিকাশ চন্দ্র সাহা বলেন, সরকার যদি ক্ষুদ্র ডাল মিলের মালিকদের প্রণোদনাসহ সুযোগ–সুবিধার আওতায় নিয়ে আসে, তাহলে এই ব্যবসা টিকবে। তিনি বলেন, সরকার বড় বড় কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য কিনে সারা দেশে টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে বিতরণ করছে। এসব পণ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে করা হলে তাঁদের উপকার হতো। বড় কোম্পানিগুলোর দাপট থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।