ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি কমেনি

প্রথম আলো গ্রাফিকস

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দিয়ে হইচই ফেলে দেন। তারপর গত আগস্টে সত্যি সত্যি সেই পাল্টা শুল্ক কার্যকর করেন তিনি। বৈশ্বিক বাণিজ্যে তৈরি হয় নজিরবিহীন অস্থিরতা।

প্রথমে অতিরিক্ত পাল্টা শুল্কের চাপে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি কমার শঙ্কা তৈরি হয়। পরে সেই শুল্ক প্রতিযোগী দেশগুলোর কাছাকাছি নেমে আসায় দুশ্চিন্তা কিছুটা দূর হয়। শুধু তা-ই নয়, চীন ও ভারতের পণ্যে পাল্টা শুল্ক বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে জন্য নতুন ব্যবসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যদিও এখন পর্যন্ত সেই সুযোগ খুব বেশি নিতে পারেনি বাংলাদেশ। আবার অতিরিক্ত ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্কের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানিও কমেনি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৩৭৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এই রপ্তানি গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র পৌনে ৫ শতাংশ বেশি। যদিও বিদায়ী অর্থবছরে এই বাজারে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশ। সে সময় রপ্তানি হয়েছিল ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য।

বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকেরা বলছেন, পাল্টা শুল্ক আরোপ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে অধিকাংশ পণ্যের দাম বেড়েছে। সে জন্য মার্কিন ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। সে কারণে ক্রয়াদেশ আগের তুলনায় কমেছে। আবার চীনের ওপর অত্যধিক শুল্ক আরোপ হওয়ায় সেখান থেকে তৈরি পোশাক, জুতাসহ বিভিন্ন পণ্যের ক্রয়াদেশ সরছে। যদিও সরে আসা এই ক্রয়াদেশের ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশ নিতে পারলেও বড় অংশই পারছে না। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কারণেও অনেক পুরোনো ক্রেতা কম ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশটিতে রপ্তানি বাড়েনি।

আমদানি-রপ্তানি
ফাইল ছবি

৩৭ থেকে ২০ শতাংশ শুল্ক

যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে, সেসব দেশের ওপর ২০২৫ সালের ২ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক বা রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ আরোপ করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের ৫৭টি দেশের ওপর বিভিন্ন হারে বাড়তি পাল্টা শুল্ক বসানো হয়। তখন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক ছিল ৩৭ শতাংশ। তারপর ৯ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন প্রেসিডেন্ট। যদিও সব দেশের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর করা হয়।

পরে ৭ জুলাই বাংলাদেশিসহ ১৪ দেশের পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করে মার্কিন প্রশাসন। হোয়াইট হাউসের ৯০ দিনের শুল্কবিরতির সময়সীমা শেষ হতে চলায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ ঘোষণা দেন। এর আগে ৯ জুলাই থেকে শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও সেটি পিছিয়ে ১ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। নতুন ঘোষণায় বলা হয়, বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক হবে অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ।

এদিকে পাল্টা শুল্ক কমাতে বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরের সঙ্গে দর-কষাকষি কর। শুরু থেকে এ কাজে এমন ব্যক্তিদের পাঠানো হয়েছে, যাঁরা আলোচনাকে একটা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেননি। জুলাইয়ে দ্বিতীয় দফা আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আগে নেতৃত্বে আসেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। ব্যবসায়ী নেতারা প্রথম থেকে দর-কষাকষির প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের যুক্ত করার অনুরোধ করেন। একেবারে শেষ সময়ে এসে সরকার ব্যবসায়ীদের পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে।

শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বাণিজ্য-ঘাটতি কমিয়ে আনতে নানামুখী পদক্ষেপ নেন। তাঁরা পণ্য আমদানির জন্য সমঝোতা ও অঙ্গীকার করেন। সরকারি-বেসরকারি খাতের সম্মিলিত চেষ্টায় বাংলাদেশের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নেমে আসে।

ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক কমানো হয়। প্রতিযোগী দেশের মধ্যে পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৫ (পরে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হয়), ইন্দোনেশিয়ার ওপর ১৯, মালয়েশিয়ার ওপর ১৯, মিয়ানমারের ওপর ৪০, ফিলিপাইনের ওপর ১৯, শ্রীলঙ্কার ওপর ২০ ও ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। ৭ আগস্ট এই পাল্টা শুল্ক কার্যকর করা হয়।

ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

পাল্টা শুল্কের প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের মধ্যে তৈরি পোশাকই সিংহভাগ। তবে পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেনি। তবে চীন ও ভারতের শুল্ক বেশি হওয়ায় ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। সেই সুযোগ খুব বেশি নিতে পারেনি বাংলাদেশ।

ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বাজারটিতে ৩২২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র ৩ শতাংশ বেশি। যদিও বিদায়ী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় ১৪ শতাংশের কাছাকাছি।

শীর্ষ রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ না বাড়লেও জুতা রপ্তানি তুলনামূলক ভালো করেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাজারটিতে চামড়ার জুতার রপ্তানি বেড়েছে ২১ শতাংশ। আর চামড়াবিহীন জুতার রপ্তানি আগের চেয়ে বেড়েছে তিন গুণ বা ২২২ শতাংশ। তবে চামড়া ও চামড়াবিহীন মিলে রপ্তানি পরিমাণ কম হওয়ায় (১৩ কোটি ডলার) সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। জুলাই-নভেম্বরে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি মাত্র পৌনে ৫ শতাংশ। তবে পোশাকের বাইরে বিকল্প পণ্য হিসেবে জুতা রপ্তানির হিস্যা বাড়ছে, এটা ভালো খবর।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বেড়েছে

বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি সেভাবে না বাড়লে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বেড়েছে। গত জুলাইয়ের শেষ দুই দিন পাল্টা শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ইউএসটিআর দপ্তরের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদলের চূড়ান্ত দর-কষাকষি হয়। সে সময় বাংলাদেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে। এসব সভায় তাৎক্ষণিকভাবে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সয়াবিনবীজ ও তুলা আমদানির সমঝোতা চুক্তি করেন তাঁরা। আবার বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি প্রতিশ্রুতিও দেন। শুধু তা-ই নয়, সরকারি পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঁচ বছরে ৭ লাখ করে মোট ৩৫ লাখ টন গম কেনার জন্য সমঝোতা চুক্তি হয়। ৯৩৬ কোটি টাকায় দুই জাহাজ কেনা চূড়ান্ত করেছে সরকার।

গত অক্টোবরে সরকারি চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫৬ হাজার ৯৫০ টন গম দেশে আসে। বাংলাদেশের তিনটি বড় শিল্পগোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক বছরে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের সয়াবিনবীজ আমদানির জন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল (ইউএসএসইসি) ও ইউএস সয়ের সঙ্গে চুক্তি করে গত নভেম্বরে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, সিটি গ্রুপ ও ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ।