সরকারের কাছে ৭ হাজার কোটি টাকার সুদমুক্ত ঋণ চায় ৯ শিল্পপ্রতিষ্ঠান

বেক্সিমকো গ্রুপের বন্ধ কারখানাগুলোর শ্রমিক–কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধে সরকারের পক্ষ থেকে ঋণসহায়তা দেওয়ার পর প্রায় একই ধরনের সহায়তা চেয়ে একের পর এক আবেদন আসছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে। গত কয়েক মাসে নয়টি প্রতিষ্ঠান নতুন করে সরকারের কাছে সুদমুক্ত ঋণের আবেদন করেছে।

প্রতিষ্ঠানগুলো হলো দেশবন্ধু গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, ইফাদ গ্রুপ, র‌্যাংগস গ্রুপ, নাইটিঙ্গেল ফ্যাশন, টিএনজেড গ্রুপ, আরএইচ ডেনিম অ্যান্ড রিসাইক্লিং কম্পোজিট, ফাইয়াজ কম্পোজিট ও জেএস লিংক। গত আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে প্রতিষ্ঠানগুলো টাকার জন্য দ্বারস্থ হয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে। এর বাইরে আগে থেকে নাসা গ্রুপের ঋণসহায়তার একটি আবেদনও জমা রয়েছে মন্ত্রণালয়ে। এসব প্রতিষ্ঠানের কেউ শ্রমিক–কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন ভাতা দিতে, কেউ বকেয়া বেতন–বোনাস পরিশোধ, আবার কেউ বন্ধ কারখানা চালু করতে অর্থসহায়তা চেয়ে আবেদন করেছে। এর মধ্যে আটটি প্রতিষ্ঠানকে সহায়তার জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে সরকারের কাছে সাত হাজার কোটি টাকা চেয়েছে।

এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপাতত মনে হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি যৌক্তিক নয়। তবে যৌক্তিক কারণ থাকলে নীতিসহায়তা দেওয়া যেতে পারে, তার বেশি কিছু নয়।’ বেক্সিমকো গ্রুপকে সরকারের পক্ষ থেকে ঋণসহায়তা করার পর থেকেই এ ধরনের আবেদন বেড়েছে বলে মনে করেন গভর্নর।

গত ফেব্রুয়ারিতে বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধে ৫২৫ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় দিয়েছে ৩২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা আর ২০০ কোটি টাকা দেওয়া হয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে। পোশাক খাতের শ্রম অসন্তোষ নিরসনে গত দুই বছরে বেক্সিমকো গ্রুপসহ ১২টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৭০৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার।

চলতি মূলধন চায় দেশবন্ধু

গত সেপ্টেম্বরে দুই হাজার কোটি টাকার চলতি মূলধন ও ঋণ পুনঃ তফসিলের সুবিধা চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছে দেশবন্ধু গ্রুপ। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় গভর্নরকে এক চিঠিতে বলেছে, ১৯৮৯ সাল থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প স্থাপন করে ২৫ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছে দেশবন্ধু গ্রুপ। কাঁচামাল ও চলতি মূলধনের অভাবে গ্রুপটির বিভিন্ন কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। পাঁচটি কারখানা উৎপাদন সক্ষমতার ২৫ শতাংশ উৎপাদন করতে পারছে। গ্রুপটির শ্রমিক অসন্তোষ নিরসন ও কারখানাগুলোর সচল রাখতে চলতি মূলধন জোগান এবং ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা প্রয়োজন।

আপাতত মনে হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি যৌক্তিক নয়। তবে যৌক্তিক কারণ থাকলে নীতিসহায়তা দেওয়া যেতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। বেক্সিমকো গ্রুপকে সহায়তা করার পর থেকেই এ ধরনের আবেদন বেড়েছে।
আহসান এইচ মনসুর, গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

৩,০০০ কোটি টাকা চায় যমুনা গ্রুপ

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে তিন হাজার কোটি টাকা সহায়তা চেয়েছে যমুনা গ্রুপ। গ্রুপটি চায় ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ডসহ পাঁচ বছর মেয়াদি সুদবিহীন প্রণোদনা। সরকারের কাছে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান ঋণসহায়তা চেয়ে আবেদন করেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহায়তা চেয়েছে গ্রুপটি। শতভাগ রপ্তানিমুখী গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা প্রদান, পরিষেবা বিল, অপরিহার্য কাঁচামালের খরচ জোগাতে এ অর্থ চেয়েছে গ্রুপটি।

এ বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে যমুনা গ্রুপের পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে পারছেন না।

আর্থিক চাপে র‍্যাংগস গ্রুপ

শ্রম অসন্তোষের আশঙ্কার কথা জানিয়ে ১৬ অক্টোবর শ্রম উপদেষ্টার কাছে সহায়তা চেয়ে আবেদন করেছে র‍্যাংগস গ্রুপ। গ্রুপের পাঁচ হাজার শ্রমিক–কর্মচারীর নিয়মিত বেতন–ভাতা দিতে ও উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে নিতে গ্রুপটি ৭৫০ কোটি টাকা সহায়তা চেয়েছে। এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ সাত বছর মেয়াদে সুদমুক্ত ঋণ চেয়ে আবেদন করেছে গ্রুপটি।

আবেদনে র‍্যাংগস গ্রুপ বলেছে, সাম্প্রতিক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আমদানি–রপ্তানিবান্ধব পরিবেশের সংকটের কারণে গুরুতর আর্থিক চাপে রয়েছে তারা। গত বছরের জুলাইয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ওই সময় দেশব্যাপী শিল্পকারখানা অচল ছিল। উচ্চসুদে ব্যাংকঋণ নিয়ে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তখন শ্রমিকদের বেতন–ভাতা পরিশোধ করতে হয়েছে। এসব কারণে আর্থিক চাপে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

জানতে চাইলে র‍্যাংগস গ্রুপের উপদেষ্টা সদরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের কাছে সহায়তা চেয়েছি। আমরা আশা করছি, সরকার আমাদের আবেদন ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবে।’

কারখানা সচল রাখতে সহায়তা চায় ইফাদ

ইফাদ গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ইফাদ অটোস ১৯৮৫ সাল থেকে দেশে অশোক লেল্যান্ড ব্র্যান্ডের বিভিন্ন মডেলের এসি ও নন-এসি বাস এবং ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান বাজারজাত করে আসছে। ২০১৭ সালে ভারতীয় গাড়ি নির্মাতা অশোক লেল্যান্ডের কারিগরি সহায়তায় ইফাদ অটোস ঢাকার ধামরাইয়ে গাড়ি উৎপাদন শুরু করে। বেসরকারি উদ্যোগে এটিই দেশের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক গাড়ি উৎপাদন কারখানা বলে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানটি গত ১১ সেপ্টেম্বর ৮৫০ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছে। গ্রুপটি বলেছে, শ্রমিক কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন–ভাতা পরিশোধ ও কারখানা সচল রাখার জন্য সুদমুক্ত এই ঋণসুবিধা দরকার।

সরকার কোনো ঋণ দেয় না। কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে শ্রমিকদের সহায়তা করা হয়, এটা ঠিক। আবেদনগুলো আসছে বেক্সিমকোকে সহায়তা করার পর থেকেই। বেক্সিমকোর সঙ্গে অন্যদের মিলিয়ে দেখলে হবে না।
সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া, শ্রমসচিব

আবার ঋণ চায় টিএনজেড

টিএনজেড গ্রুপ চায় ঢাকার মহাখালীতে সাততলা বাড়ি বন্ধক রেখে ৪০ কোটি টাকার অর্থসহায়তা। এ টাকায় তারা গ্রুপের শ্রমিক–কর্মচারীদের বাকি পাওনা পরিশোধ করতে চায়।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, টিএনজেড গ্রুপকে আগেও টাকা দিয়েছে সরকার। গত বছরের ২৮ নভেম্বর এ গ্রুপকে ১০ কোটি টাকা দেয় অর্থ বিভাগ। আর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিল থেকেও একই দিনে দেওয়া হয় আরও ছয় কোটি টাকা। আর চলতি বছরের ২৮ মে দেওয়া হয় আরও ২২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গ্রুপটিকে এরই মধ্যে ৩৮ কোটি টাকা ঋণসহায়তা দিয়েছে সরকার।

জানা যায়, টিএনজেড গ্রুপের মূল পরিচালক শাহাদাৎ হোসেন শামীম বিদেশে চলে গেছেন। এই গ্রুপের পরিচালক শরিফুল শাহীন এর আগে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, গ্রুপের ওয়াশিং প্ল্যান্ট ও ঢাকায় মালিকের বাড়ি বিক্রির চেষ্টাও করা হয়েছে।

জমি বন্ধকে ঋণ চায় নাইটিঙ্গেল

বন্ধ কারখানা চালু করতে ৫০০ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ চায় শতভাগ রপ্তানিমুখী নাইটিঙ্গেল ফ্যাশন। গাজীপুরে সাততলা ভবনসহ তিন প্লটে ২১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের জমি ও গাজীপুরে ৬০ বিঘা জমি বন্ধক দিয়ে এই সহায়তা নিতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। সরকারের এই সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটি কারখানা চালুর পাশাপাশি শ্রমিক কর্মচারীদের বকেয়া পরিশোধের কথা বলেছে।

নাইটিঙ্গেল ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল সালাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কারখানায় চার হাজার শ্রমিক–কর্মচারী কাজ করতেন। এযাবৎ রপ্তানি আয়ও ভালোই হয়েছে। ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে কারখানা এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। এখন সরকারের সহায়তায় আবার ঘুরে দাঁড়াতে চান তাঁরা।

এ ছাড়া আর এইচ ডেনিম অ্যান্ড রিসাইক্লিং কম্পোজিট ৫০ কোটি টাকা, ফাইয়াজ কম্পোজিট ৩০ কোটি এবং জেএস লিংক ৫০ কোটি টাকা চেয়েছে সরকারের কাছে।

এ বিষয়ে শ্রমসচিব সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, সরকার কোনো ঋণ দেয় না। কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে শ্রমিকদের সহায়তা করা হয়, এটা ঠিক। আবেদনগুলো আসছে বেক্সিমকোকে সহায়তা করার পর থেকেই। বেক্সিমকোর সঙ্গে অন্যদের মিলিয়ে দেখলে হবে না। সংকটে না পড়লে তো কেউ আবেদন করত না—এমন প্রশ্নের জবাবে শ্রমসচিব আরও বলেন, এটা ঠিক। এখন কিছু করার থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক করতে পারে।