বাবার আদর্শেই আকিজ বশির গ্রুপের যাত্রা শুরু

সেখ আকিজ উদ্দিন ছুটে চলতেন গ্রাম থেকে নগর, নগর থেকে মহানগরে। শহরের পিচঢালা পথ কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেঠোপথে ছিল তাঁর নিরন্তর ছুটে চলা। সঙ্গী ছিল একটি ভেসপা আর দৃঢ় মনোবল। দ্রুতগতির ভেসপা চালিয়ে আকিজ উদ্দিন যখন ছুটে চলতেন, তাঁর সফেদ পাঞ্জাবি উড়তে থাকত…। এ যেন ঘোড়ার পিঠে চড়ে কোনো রাজার নতুন রাজ্য জয়ের স্বপ্ন আর চ্যালেঞ্জ নিয়ে ছুটে চলা। আর পেছনে দক্ষ সেনাপতির মতো সাহস জুগিয়েছেন তাঁর সন্তানেরা। সেখ আকিজ উদ্দিন কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড জয় না করলেও রাজত্ব করেছেন ব্যবসার ভূখণ্ডে। নিজের নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন আকিজ গ্রুপ। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে বাড়িয়েছেন ব্যবসার পরিধি।

আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিন জীবন সংগ্রাম শুরু করেছিলেন কলকাতার রাস্তায় ফেরিওয়ালা হিসেবে। আকিজ উদ্দিনের বাবা ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। মৌসুমি ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। বাবার কাছ থেকেই ব্যবসার হাতেখড়ি দেশের বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা সেখ আকিজ উদ্দিনের।

শুরুটা যেভাবে আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিন জীবন সংগ্রাম শুরু করেছিলেন কলকাতার রাস্তায় ফেরিওয়ালা হিসেবে। তাঁর আদি বাড়ি খুলনা জেলার ফুলতলা থানার মধ্যডাঙ্গা গ্রামে। আকিজ উদ্দিনের বাবা ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। মৌসুমি ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। বাবার কাছ থেকেই ব্যবসার হাতেখড়ি দেশের বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা সেখ আকিজ উদ্দিনের। তীব্র দারিদ্র্য আর অসচ্ছলতার মধ্যে তাঁর বেড়ে ওঠা।

১৯৪২ সালে বাবার কাছ থেকে মাত্র ১৬ টাকা নিয়ে বাড়ি ছাড়েন সেখ আকিজ উদ্দিন। এরপর কলকাতায় কমলালেবু বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম দিকে ব্যবসায় সুবিধা করতে না পারায় কয়েক দফায় বদলাতে হয়েছে ব্যবসা ও শহর। তাতেও সুবিধা করতে না পেরে ফিরে আসেন জন্মভূমিতে। এরপর ১৯৫২ সালে শুরু করেন বিড়ির ব্যবসা। এর মাধ্যমেই দেখা পান সাফল্যের। তবে যেতে হয়েছে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে।

তবে ভেঙে পড়েননি কখনো। এরপর একে একে প্রতিষ্ঠা করেন আকিজ তামাক ফ্যাক্টরি, আকিজ নেভিগেশন, আকিজ জুট মিল, আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরি, আকিজ সিমেন্ট ফ্যাক্টরিসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। বাবার দেখানো পথে সন্তানদের হেঁটে চলা আকিজ উদ্দিনের ১৫ সন্তান। ১০ ছেলে, পাঁচ মেয়ে। বাবার দেখানো পথে সব সন্তানই সফল হয়েছেন।

বড় ছেলে ডাক্তার সেখ মহিউদ্দিন আদ্-দ্বীন হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক এবং আকিজ বিড়ির চেয়ারম্যান। অন্য সন্তানদের মধ্যে সেখ মোমিন উদ্দিন ছিলেন এসএএফ চামড়া ফ্যাক্টরির এমডি, যিনি করোনাকালে মারা যান। সেখ আফিল উদ্দিন সংসদ সদস্য ও আফিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সেখ বশির উদ্দিন আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ ছাড়া সেখ নাসির উদ্দিন, সেখ আমিন উদ্দিন, সেখ জামিন উদ্দিন, সেখ আজিজ উদ্দিন, সেখ জামিল উদ্দিন—সবাই আকিজ গ্রুপ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত।

সেখ আকিজ উদ্দিন বলতেন, আগুন হয়তো মনের শক্তি দিয়ে হাতে চেপে রাখা যায়। কিন্তু ক্ষমতা ও সম্পদ ধরে রাখা তার চেয়ে আরও অনেক কঠিন। বাবার এই বাণী ধারণ করে তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি সমাজসেবার হাল ধরে রেখেছেন সন্তানেরা।

সেখ বশির উদ্দিন জানান, ‘বাবার কাছে নিয়মিত ধর্ম-কর্ম পালনের পরই ছিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার স্থান। এ ছাড়া তাঁর সময়জ্ঞান ছিল উল্লেখ করার মতো। তিনি কোনো মিটিংয়ে এক মিনিট পরে আসেননি। আমি তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুটি অনুসরণ করে লাভবান হয়েছি। বাবার মধ্যে কোনো আত্ম অহমিকাবোধ ছিল না। তিনি সবকিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তাঁর দূরদর্শিতার কারণেই আকিজ গ্রুপ সম্প্রসারিত হয়েছে।’

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত সেখ বশির উদ্দিন বলেন, ‘বাবার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। কিন্তু তাঁর শিক্ষার প্রতি ছিল প্রবল প্রেম। তিনি আমাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেই ব্যবসায় যুক্ত করতেন। তাঁর সততা, ধৈর্যশীলতা, মেধা ও সহনশীলতার কারণেই আকিজ গ্রুপ সাফল্যের শিখরে উঠেছে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই তিনি আকিজ গ্রুপকে দেশের সেরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বানিয়েছেন।

মা এর সঙ্গে সেখ বশির উদ্দিন

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের নাম। পণ্যের মানের বিষয়ে বাবা কোনো দিন আপস করেননি। আমরাও এ বিষয়ে কোনো আপস না করেই এগিয়ে যাচ্ছি।’ আকিজ গ্রুপের আদর্শেই আকিজ বশির গ্রুপের যাত্রা সফল বাবার উত্তরসূরি হিসেবে সেখ বশির উদ্দিনের হাত ধরেই যাত্রা শুরু করেছে আকিজ বশির গ্রুপের। এত দিন সেখ বশির উদ্দিন উত্তরাধিকার সূত্রে আকিজ গ্রুপের ব্যবসা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন সেখান থেকে আলাদা হয়ে বাবার ও নিজের নামে নিজের মালিকানায় শুরু করেছেন আকিজ বশির গ্রুপ। এখন থেকে নতুন এ নামেই ব্যবসা পরিচালনা করবেন সেখ বশির উদ্দিন।

আকিজ বশির গ্রুপের অধীনে রয়েছে সিরামিকস, স্যানিটারি ও বাথওয়্যার, টেবিলওয়্যার, পার্টিকেল বোর্ড, পাট, স্টিল, চা–সহ ১৬ ধরনের ব্যবসা। বছরে এসব ব্যবসার পরিধি প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

আকিজ বশির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেখ বশির উদ্দিন জানান, ‘বাবার দেখানো পথ ও আদর্শ নিয়েই শুরু হলো আমাদের এই নতুন যাত্রা। আমার বিশ্বাস, আগামীকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াসে নিরলস কাজ করে যাবে আকিজ বশির গ্রুপ। আমাদের সবার ব্যবসাই এখন বড় হচ্ছে। বাবার পর দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে আমরা ব্যবসার হাল ধরেছি। এখন আমাদের সন্তানেরাও ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করেছে। তৃতীয় প্রজন্মের নেতৃত্বে আসার এই সময়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতৃত্বের ছাপ রাখতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আকিজ বশির গ্রুপের ফলে ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত ও শক্তিশালী হবে। ভবিষ্যতে অন্য ভাইয়েরাও হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নেবেন। তাতে বাবার স্মৃতি অক্ষুণ্ন রেখে সবাই ব্যবসা আধুনিকায়নের ব্যাপারে গুরুত্ব দেবেন বলে আমি মনে করি।’