কনটেইনার আমদানিতে শুল্ক কমায় কী লাভ হবে

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পণ্য পরিবহনের কনটেইনার আমদানিতে শুল্কহার কমানো হয়েছে। গত ১ জুন থেকে এই শুল্কহার কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশে কনটেইনার পরিবহন খাতে যাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়, সে জন্য শুল্কহারে এই পরিবর্তনের কথা বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

কনটেইনার আমদানি ও এই খাতের আরও তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রয়োজনে কনটেইনার আমদানি হচ্ছে। ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহনের সুবিধার জন্যই পণ্যসহ কনটেইনার কিনে আনা হয় উন্নয়ন প্রকল্পে। ফলে শুল্ক কমানোর এই সুবিধা প্রথম পাচ্ছে মূলত সরকারি সংস্থা।

আবার বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলো শিল্পে ব্যবহারের কাজে শিপিং কনটেইনার আমদানি করে। এভাবে গত পাঁচ বছরে (২০১৮-২০২২) ৫ হাজার ৪১৭টি কনটেইনার আমদানি হয়েছে। ক্যারিয়ার বা পণ্য পরিবহনের ব্যবসার জন্য দুই দশকে কনটেইনার আমদানির তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

শুল্কহার কমেছে সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ

সাধারণ কনটেইনার আমদানিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট করভার ছিল ৩৭ শতাংশ। এখন তা কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। হিমায়িত পণ্যের কনটেইনারের আমদানি শুল্ক ৩১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। বাজেট ঘোষণার দিন থেকে নতুন শুল্কহার কার্যকর হয়েছে।

শুল্কহার কমানোয় প্রতি কনটেইনারে করভার কিছুটা কমবে। যেমন ২০ ফুট লম্বা একটি সাধারণ কনটেইনারের আমদানিমূল্য ২ হাজার ৫০০ হাজার ডলার হলে আগে এ ক্ষেত্রে করভার ছিল ৯৯ হাজার ৯০০ টাকা। নতুন কর হারের কারণে এখন দিতে হবে ৫৪ হাজার টাকা।

শিপিং কোম্পানি ক্রাউন নেভিগেশন লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহেদ সরওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, আমদানিতে খরচ কম হলে শুধু কনটেইনার ভাড়া দেওয়ার কোম্পানি গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি হবে। আবার পণ্য আমদানির সময় কনটেইনারসহ কিনেও সুবিধা মিলবে। এতে বন্দর বা ডিপোতে কনটেইনার পড়ে থাকার জন্য যে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, তা লাগবে না। পণ্য খালাস শেষে এই কনটেইনার দিয়ে আবার ব্যবসাও করা যাবে।

শতভাগ বিদেশিদের হাতে

কনটেইনার ব্যবসার পুরোটাই এখন বিদেশি কোম্পানির হাতে। এই খাতে শীর্ষে রয়েছে ডেনমার্কভিত্তিক মার্সক লাইনস, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক এমএসসির মতো বৈশ্বিক বড় কোম্পানি। এ ছাড়া ছোট আকারে শুধু কনটেইনার ব্যবসা রয়েছে, এমন বিদেশি কোম্পানিও রয়েছে। বাংলাদেশে সরাসরি এবং এজেন্টের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিগুলো ব্যবসা পরিচালনা করে।

সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে বহুমুখী ব্যবসার একটি হলো কনটেইনার খাত। এতে তিনভাবে ব্যবসা করছে বিদেশি কোম্পানিগুলো। প্রথমত, শুধু শিপিং কোম্পানিগুলোর কাছে কনটেইনার ভাড়া দেওয়া। প্রতি কনটেইনারে (২০ ফুট লম্বা) দিনে আড়াই থেকে পাঁচ ডলারের মতো আয় হতে পারে তাতে।

দ্বিতীয়ত, নিজস্ব কনটেইনারের পাশাপাশি ভাড়া নিয়ে কনটেইনার পরিচালনা। সে ক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানিকারকের প্রতিনিধির কাছ থেকে পণ্য পরিবহনের জন্য ভাড়া নিয়ে ওই কনটেইনারে করে পণ্য গন্তব্যে পৌঁছে দেয় এসব কোম্পানি। এ জন্য নিজেরাই জাহাজ ঠিক করার কাজটিও তারা করে। শিপিংয়ের ভাষায় এসব কোম্পানি ‘নন ভেসেল অপারেটিং কমন ক্যারিয়ার’ বা এনভিওসিসি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে এ রকম ৩০-৩৫টির মতো বিদেশি কোম্পানি ব্যবসা করছে।

তৃতীয়ত, কনটেইনার জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলোর নিজেদের জাহাজে নিজেদের কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের ব্যবসা। অর্থাৎ কনটেইনার ও জাহাজ দুটিই এসব কোম্পানির। এ ক্ষেত্রে পরিবহন ভাড়ার পুরোটাই এ ধরনের কোম্পানি পেয়ে থাকে। শিপিংয়ের ভাষায় এ ধরনের কোম্পানি ‘মেইন লাইন অপারেটর’ হিসেবে পরিচিত।

জাহাজ ও কনটেইনার ভাড়া নিয়েও তারা ব্যবসা পরিচালনা করে। শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানি মার্সক ও এমএসসির নিজস্ব জাহাজ ও কনটেইনার রয়েছে। বাংলাদেশে কনটেইনারের পাশাপাশি জাহাজ পরিচালনা করছে এমন বিদেশি কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ১২।

কনটেইনার খাতে ব্যবসার চিন্তাভাবনা

বাংলাদেশে কনটেইনারের ব্যবসা একসময় ছিল চট্টগ্রামের কিউসি গ্রুপের হাতে। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গত শতকের ৯০ দশকের শেষে কনটেইনার জাহাজের পাশাপাশি কনটেইনার পরিচালনা ব্যবসাও শুরু করে গ্রুপটি। তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়, ২০০৫ সালে গ্রুপটির বহরে থাকা আটটি কনটেইনার জাহাজের সব কটিই বিক্রি করে দেওয়া হয়। কনটেইনারের ব্যবসাও সে সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়।

২০২০ সালের জুনে দেশীয় কোম্পানি কর্ণফুলী লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এইচআর লাইনসের হাত ধরে কনটেইনার জাহাজ পরিচালনার ব্যবসা আবার শুরু হয় এদেশে। এইচআর লাইনস এখন আটটি ফিডার জাহাজ পরিচালনা করছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি জাহাজে কনটেইনার রাখার জায়গা (স্লট) ভাড়া দিচ্ছে শুধু।

জানতে চাইলে কর্ণফুলী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এইচআর লাইনসের পরিচালক হামদান হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কনটেইনার খাতকে সম্ভাবনাময় হিসেবে চিহ্নিত করায় সরকারকে সাধুবাদ জানাই। তবে সুফল পেতে হলে জাহাজ আমদানির মতো কনটেইনার আমদানিতে ন্যূনতম করভার নির্ধারণ করা উচিত। সম্ভাবনাময় এই খাতে আমরা আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের চিন্তাভাবনা করছি। কারণ, জাহাজের ‘স্লট’ ভাড়া দেওয়ার মতো তখন কনটেইনার ভাড়া বাবদ ডলার আর বিদেশি কোম্পানিকে দিতে হবে না।

বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে এখন কোনো কোম্পানির কনটেইনার ব্যবসা নেই। যদিও বাংলাদেশি কিছু কোম্পানি বিদেশে খোলা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কনটেইনার ব্যবসা করছে বলে শিপিং সূত্রে জানা গেছে। শুল্কহার কিছুটা কমিয়ে আনায় এসব কোম্পানির জন্য এখন বৈধভাবেই দেশে ব্যবসা শুরুর সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ডলার সাশ্রয় হবে

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে ২০২১-২২ অর্থবছরে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ভাড়া বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে ৫১৫ কোটি ডলার। সাধারণ পণ্যবাহী ও কনটেইনার জাহাজ এবং কনটেইনার কোম্পানিগুলো এই ভাড়ার অর্থ পেয়েছে। দেশীয় বহরে থাকা ৯৫টি জাহাজের মাধ্যমে কিছুটা সাশ্রয় হলেও এই অর্থের বড় অংশই চলে যাচ্ছে বিদেশে।

শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও ফ্রেইট ফরওয়ার্ডস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ খাতে বিনিয়োগে বহুমুখী সুবিধা মিলবে। প্রথমত, কনটেইনার ভাড়া দিয়ে বা পরিচালনা বাবদ বিদেশি মুদ্রা আয় হবে। আর দ্বিতীয়ত, বন্দরে বেশি সময় কনটেইনার পড়ে থাকায় বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ডলারে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। দেশীয় কোম্পানি হলে আর ডলারে এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। অর্থাৎ এই দুইভাবে ডলার সাশ্রয় হতে পারে।