মজুরি আন্দোলনে হতাহতের ঘটনা অনুসন্ধানে গণতদন্ত কমিটি গঠন

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। আজ শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে
ছবি: সংগৃহীত

দেশে তৈরি পোশাকশিল্পে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে গত বছরের অক্টোবর ও নভেম্বরে শ্রমিক নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের লক্ষ্যে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট একটি গণতদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটিতে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী, শ্রমিক সংগঠক, অর্থনীতিবিদ, লেখক, গবেষকেরা রয়েছেন।

রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ হলে আজ শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে ‘মজুরি আন্দোলনে শ্রমিক হতাহতে গণতদন্ত কমিটি’ নামে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি জহিরুল ইসলাম। নবগঠিত গণতদন্ত কমিটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানিয়েছে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে আহ্বায়ক ও জহিরুল ইসলামকে সদস্যসচিব করে গঠিত ৩১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক মনজুরুল আহসান খান, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সাদিয়া আরমান, ঐক্য ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম এ সবুর, লেখক-গবেষক মাহা মির্জা, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু, গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক বাবুল হোসেন প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘শ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্য মজুরি চাওয়ার পরিণামে শিল্পাঞ্চল রক্তাক্ত হয় কেন? কেন অকালমৃত্যু হয় নারী-পুরুষের? কেন জখম হয় শত শত শ্রমিক? কেন রাষ্ট্র তার সব রকম সংস্থা নিয়ে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়? শিল্প পুলিশ আসলে কার স্বার্থ রক্ষা করে, মালিকের না শ্রমিকের?—এই সব প্রশ্নের উত্তর জানার অধিকার রয়েছে বাংলাদেশের সব নাগরিকের। সরকার এসব অনিয়ম ও জুলুম-হত্যাকাণ্ডের কোনো কার্যকর তদন্ত না করায় নাগরিকদের পক্ষ থেকে আমরা মজুরি আন্দোলনে শ্রমিক হতাহতের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গণতদন্ত কমিটি গঠন করেছি।’

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, ‘এই কমিটির অধীনে যে পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা রাস্তায় আন্দোলন করছিলেন, সেটি ও তাঁদের দাবি পর্যালোচনা; আন্দোলন নিয়ে মালিকপক্ষ, পুলিশ, বিজিএমইএসহ বিভিন্ন সংস্থার ভূমিকা; শ্রমিকদের আন্দোলনে হামলায় জড়িতদের শনাক্তকরণ; গুলিবর্ষণকারীদের পরিচয় ও কারণ উদ্‌ঘাটন; নিহত-আহত শ্রমিকদের পরিচয় প্রকাশ; হতাহতের ঘটনায় মামলা, তদন্ত, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি বিধান বিষয়ে সরকার ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পদক্ষেপ ও ব্যাখ্যা এবং শ্রমিকদের মজুরি, কর্মপরিবেশ, অধিকার নিয়ে অস্থিরতা ও দমন–পীড়ন বন্ধ করতে করণীয় নিয়ে গভীর অনুসন্ধান চালানো হবে। এ জন্য আমরা প্রকাশিত খবর, লেখালেখি, রিপোর্ট পর্যালোচনার পাশাপাশি শ্রমিক, মালিক ও পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বক্তব্য গ্রহণ করব। নিহত শ্রমিক পরিবারসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হবে।’

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঘোষিত কমিটি আগামী ১৫ মের মধ্যে তদন্তের কাজ শেষ করবে। ওই মাসের শেষ সপ্তাহে গণতদন্তের প্রতিবেদন জনসমক্ষে পেশ করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন মনজুরুল আহসান খান, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সাদিয়া আরমান, মোশরেফা মিশু, বাবুল হোসেন প্রমুখ।

রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে প্রতি পাঁচ বছর পরপর নতুন মজুরিকাঠামো গঠন করা হয়। মালিক, শ্রমিক ও সরকারপক্ষের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত বোর্ড মজুরি হার প্রস্তাব করে। শ্রম মন্ত্রণালয় তা ঘোষণা করে। ২০১৮ সালে নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করা হয়েছিল ৮ হাজার টাকা। নতুন কাঠামো হওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়ার কথা। তবে ২০২২ ও ২০২৩ সালে নিত্যপণ্যের মূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির কারণে শ্রমিকেরা চাপে পড়েছেন।

গত বছরের এপ্রিলে প্রায় ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে সরকার নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে। তারপর ছয় মাস কালক্ষেপণ করা হয়। গত ২২ অক্টোবর বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি দাবি করে প্রস্তাব দেন। এর বিপরীতে মালিকপক্ষ প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ১০ হাজার ৪০০ টাকার মজুরি প্রস্তাব দেয়।

পরদিন থেকেই গাজীপুরে মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে শ্রমিকেরা আন্দোলনে নামেন। পরে আশুলিয়া-সাভার ও মিরপুরে শ্রম অসন্তোষ ছড়ায়। তিন সপ্তাহের এই আন্দোলনে রাসেল হাওলাদার, ইমরান হোসেন, আঞ্জুয়ারা খাতুন ও জালাল উদ্দিন নামে চারজন পোশাকশ্রমিক নিহত হন। আহত হন অনেকে।