রপ্তানির পরিসংখ্যানে এখনো গরমিল, ব্যবধান ১৭১ কোটি ডলারের
পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে কেলেঙ্কারি ঘটেছিল। গত বছরের জুলাইয়ে হঠাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, দীর্ঘদিন ধরে পণ্য রপ্তানির হিসাব বেশি দেখাচ্ছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। তীব্র সমালোচনার মুখে তড়িঘড়ি করে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন তিন মাস রপ্তানির তথ্য প্রকাশও বন্ধ থাকে। সেই ঘটনার পর একটি অর্থবছর শেষ হয়েছে। তারপরও পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান পুরোপুরি নিখুঁত হয়নি।
বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে ইপিবি রপ্তানির যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, সেখানে সরাসরি পণ্য রপ্তানির সঙ্গে স্থানীয় রপ্তানি ও নমুনা (স্যাম্পল) রপ্তানির হিসাবও যুক্ত রয়েছে। এতে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বেশি দেখানো হয়েছে। ফলে সদ্য বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও পণ্য রপ্তানির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়নি।
ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, গত অর্থবছর পর্যন্ত রপ্তানির ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নীতিনির্ধারকেরা যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেগুলো পরে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। রপ্তানির হিসাব সঠিক না হলে ভবিষ্যতে এমন সংকট আরও আসবে। ফলে রপ্তানির তথ্যে ভুলত্রুটি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
রপ্তানিতে গরমিল কত
ইপিবির হিসাব অনুযায়ী, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৮২৮ কোটি ডলারের বা ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন পণ্য। এ সময়ে এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, প্রকৃত রপ্তানির পরিমাণ ৪ হাজার ৬৫৭ কোটি ডলার বা ৪৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। তার মানে, ইপিবি যে হিসাব দিয়েছে, তার চেয়ে প্রকৃত রপ্তানি ১৭১ কোটি ডলার কম।
এদিকে এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রকৃত রপ্তানি ছিল ৪ হাজার ২৮৬ কোটি ডলার। আর ইপিবি বলছে, রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি ডলার। তার মানে, ইপিবি হিসাবের চেয়ে প্রকৃত রপ্তানি ১৬০ কোটি ডলার কম।
পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যানের আগের ভুলটি ছিল ইচ্ছাকৃত। এখনো কেন ভুলত্রুটি হচ্ছে, সেটি খুঁজে বের করে যত দ্রুত সম্ভব সংশোধন হওয়া দরকার।
কাস্টমসের শুল্কায়নের পর পণ্য রপ্তানি হয়। রপ্তানি পণ্যের সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরই এনবিআরের তথ্যভান্ডারে তা নথিভুক্ত হয়। স্থানীয় রপ্তানি (দেশের অভ্যন্তরে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ও সরঞ্জাম সরবরাহ), নমুনা রপ্তানি ও প্রকৃত রপ্তানি—এই তিন ধরনের হিসাব থাকে এনবিআরে তথ্যভান্ডারে। রপ্তানি হওয়া পণ্য থেকে কত আয় দেশে আসে, তার হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া যায়।
এনবিআর ও ইপিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এনবিআরের কাছ থেকে হিসাব নিয়ে পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান প্রকাশ করে ইপিবি। এই পরিসংখ্যানের মধ্যে স্থানীয় রপ্তানি ও নমুনা রপ্তানির হিসাবও থাকে। সেগুলো বাদ দিলে প্রকৃত রপ্তানির তথ্য মিলবে। তবে স্থানীয় রপ্তানি ও নমুনা রপ্তানির আলাদা কোনো কোড না থাকায় সেগুলো আলাদা করতে পারেন না ইপিবির কর্মকর্তারা।
আইএমএফের গাইডলাইন মেনে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান প্রতি মাসে প্রকাশ করছি।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, পরিসংখ্যান সঠিক না থাকলে নীতি প্রণয়নে ভুল হবে, এটাই বাস্তবতা। ভবিষ্যতে রপ্তানি খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনেক নীতিমালা লাগবে, তবে তথ্য পরিসংখ্যান সঠিক না থাকলে সেগুলো যথাযথ হবে না। এমনকি ব্যবসা সম্প্রসারণ ও লক্ষ্য নির্ধারণেও মারাত্মক ভুল হতে পারে। তিনি আরও বলেন, পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যানের আগের ভুলটি ছিল ইচ্ছাকৃত। এখনো কেন ভুলত্রুটি হচ্ছে, সেটি খুঁজে বের করে যত দ্রুত সম্ভব সংশোধন হওয়া দরকার।
তথ্যের গরমিলে কী হয়
বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাইয়ে হঠাৎ করে প্রকৃত পণ্য রপ্তানির ভিত্তিতে লেনদেনের ভারসাম্যের তথ্য প্রকাশ করে। এর ফলে পণ্য রপ্তানির হিসাবে বড় ধরনের গরমিল দেখা যায়। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল, ইপিবি দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানির হিসাব প্রকাশ করলেও সে অনুযায়ী দেশে আয় আসছে না। এ নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে।
এ ঘটনা প্রকাশ্যে আসার আগে ইপিবি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মে পর্যন্ত রপ্তানির হিসাব প্রকাশ করেছিল। তখন সংস্থাটি বলেছিল, ওই অর্থবছরের জুলাই-মে পর্যন্ত ১১ মাসে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৫ হাজার ১৫৪ কোটি ডলার। তবে পরে সংস্থাটি জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তার মানে ওই অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসেই পুরো বছরের চেয়ে ৭০৭ কোটি ডলার বেশি দেখিয়েছিল ইপিবি। সে সময় দেখা যায়, তিন অর্থবছরের ৩৪ মাসে এনবিআরের চেয়ে ২ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের রপ্তানি বেশি দেখায় ইপিবি।
একাধিক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, ইপিবির বাড়িয়ে দেখানো রপ্তানির তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিগত সরকার নীতি গ্রহণ করেছে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে রপ্তানি খাতকে সহায়তা না দিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার কমিয়ে দেওয়া, ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র করতে ব্যাংকের গড়িমসি, ঋণের কিস্তি ছয় মাসের পরিবর্তে তিন মাসে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এবং প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গাইডলাইন মেনে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান প্রতি মাসে প্রকাশ করছি। এই রপ্তানির মধ্যে স্থানীয় রপ্তানির হিসাব যুক্ত রয়েছে কি না, সেটি আমরা খতিয়ে দেখব। যদি কোনো ত্রুটি থাকে তাহলে আমরা অবশ্যই সংশোধনের উদ্যোগ নেব।’
সার্বিক বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান অনেকটা ঠিক হয়ে এলেও কোনো কোনো জায়গায় বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে। এখনো পণ্য রপ্তানি ও রপ্তানির আয় প্রত্যাবাসনের মধ্যে বড় ব্যবধান থাকায় সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। ফলে অভ্যন্তরীণ ও বহিস্থ রপ্তানি যথাযথভাবে নজরদারি করতে হবে। কোন ক্রয়াদেশের বিপরীতে অর্থ আসছে না, সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে।