রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক, তবে পোশাক ছাড়া অন্য খাতে দুশ্চিন্তা

ডলার-সংকটের এই সময়ে প্রবাসী আয় তিন মাসে ধরে কমছে। যদিও পণ্য রপ্তানি এখনো ইতিবাচক ধারায় আছে। তবে তৈরি পোশাক ছাড়া বড় সব খাতেই রপ্তানি কমে গেছে। এতে রপ্তানি খাত নিয়েও দুশ্চিন্তা কাটছে না। 

সদ্য সমাপ্ত সেপ্টেম্বর মাসে ৪৩১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ১০ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি। গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় রপ্তানি আয় বাড়লেও গত জুলাই ও আগস্টের তুলনায় তা কমেছে। গত আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় কমেছে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ আর জুলাইয়ের তুলনায় কমেছে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ। গত জুলাই ও আগস্টে রপ্তানি হয়েছিল যথাক্রমে ৪৫৯ ও ৪৭৮ কোটি ডলারের পণ্য।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে; অর্থাৎ জুলাইয়ে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) গতকাল রোববার পণ্য রপ্তানির এই হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।

মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি থাকায় চলতি অর্থবছর এখন পর্যন্ত পণ্য রপ্তানি আয় সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। অন্যদিকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত খাদ্য, বাইসাইকেলসহ প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি কমে গেছে। 

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ডলার-সংকটে ভুগছে। পণ্য রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি ডলার আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে প্রবাসী আয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের ধস নেমেছে। ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন ১৩৪ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে গত মাসে। প্রকট ডলার-সংকটের সময় প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি পণ্য রপ্তানিতে উত্থান-পতন অর্থনীতির জন্য এখন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভের ওপর চাপ আর দীর্ঘ হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। 

অর্থনীতিবিদ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং বা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, এটি ভালো খবর যে প্রথম প্রান্তিকে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কমেনি। তবে বড় উদ্বেগের জায়গা হলো, পোশাক ছাড়া অন্য কোনো রপ্তানি খাত ভালো করতে পারছে না। আমাদের সামগ্রিক রপ্তানি পোশাক খাতের ওপর ভর করেই চলছে। সরকার বহু দিন ধরে রপ্তানি বহুমুখীকরণের নানা উদ্যোগের কথা বললেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। দুই বছরের মধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাব। তখন তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর বড় আঘাত আসার শঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় অন্য খাতগুলো এগিয়ে নিতে না পারলে সামগ্রিকভাবে আমাদের রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এ জায়গাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। 

এদিকে ডলার-সংকটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। তাতে কমছে রিজার্ভ। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭০৬ কোটি ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী, প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলার। 

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মোট পণ্য রপ্তানির ৮৫ শতাংশ তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে। এ সময়ে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ১৬২ কোটি ডলারের পোশাক। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ২৭ কোটি ডলারের। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে তৈরি পোশাক খাতের মধ্যে ৬৭৬ কোটি ডলারের নিট পোশাক এবং ৪৮৫ কোটি ডলারের ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই সময়ে নিট পোশাকে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ দশমিক ৭০ শতাংশ। ওভেন পোশাকে প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত তৈরি পোশাকের পর সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ২৬ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। গত জুনে শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতের রপ্তানি কমেছিল পৌনে ২ শতাংশ। তার মানে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। 

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের রপ্তানির পরিমাণ ২৫ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। এই খাতের রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া গত তিন মাসে ২২ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য, ১৮ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের হোম টেক্সটাইল, সাড়ে ১২ কোটি ডলারের চামড়াবিহীন জুতা এবং ৯ কোটি ৯৫ ডলারের হিমায়িত খাদ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ৯ দশমিক ৬৭, হোম টেক্সটাইলে ৪৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ, চামড়াবিহীন জুতায় ১ শতাংশ এবং হিমায়িত খাদ্যের রপ্তানি কমেছে ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ।