দেশে ৩৩ বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগ

দেশে এফডিআই প্রবাহ বাড়লেও মোট স্থিতি কমেছে। এর অর্থ হলো বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাঁদের অর্জিত মুনাফা নিয়ে যাচ্ছেন।

২০২২ সালে সারা বিশ্বে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমলেও বাংলাদেশে বেড়েছে। গত বছর দেশে এফডিআই প্রবাহ ২০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪৮ কোটি ডলার, যা এখন স্থানীয় মুদ্রায় ৩৭ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা ধরে)। দেশে ১৯৯০ সালের পর এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এফডিআই। দেশে গত ৩৩ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৩৬১ কোটি ডলারের এফডিআই আসে।

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে এফডিআইপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। সামগ্রিকভাবে গত বছর এলডিসিভুক্ত দেশগুলোয় যেখানে এফডিআই প্রবাহ ১৬ শতাংশ কমেছে, সেখানে বাংলাদেশে ২০ শতাংশ বেড়েছে। সব এলডিসির পাওয়া মোট এফডিআইয়ের ৭০ শতাংশই পেয়েছে মাত্র ৫টি দেশ। এর মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ। বাকি চার দেশ হলো ইথিওপিয়া, কম্বোডিয়া, সেনেগাল ও মোজাম্বিক।

গত বুধবার বিশ্বব্যাপী প্রকাশিত জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের সর্বশেষ বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন ২০২৩–এ এই তথ্য উঠে এসেছে।

‘বাংলাদেশে এমনিতেই এফডিআইয়ের পরিমাণ অনেক কম। সে তুলনায় গত বছর কিছুটা ভালো এফডিআই এসেছে। দেখতে হবে, এখন নতুন বিনিয়োগ কতটা আসছে। যাঁরা এখানে অনেক দিন ধরে ব্যবসা করছেন, তাঁরা মুনাফার একটি অংশ আবার বিনিয়োগ করেন। সেটা এফডিআইয়ে দেখানো হয়। সে জন্য নতুন বিনিয়োগের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।’
মোস্তাফিজুর রহমান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো

দেশে ২০২০ সালে এফডিআই হ্রাসের পর ২০২১ সালে আবার বাড়ে, যা পরের বছরও বজায় থাকে। ২০২১ সালে দেশে এফডিআই এসেছিল ২৮৯ কোটি ডলার। অন্য বছরগুলোর মধ্যে দেশে ২০১৫ সালে ২২৩ কোটি ডলার, ২০১৬ সালে ২৩৩ কোটি ডলার, ২০১৭ সালে এসেছিল ২১৫ কোটি ডলার ও ২০১৯ সালে ২৮৭ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল।

দেশে ২০২২ সালে এফডিআই বাড়লেও সামগ্রিক এফডিআই স্টক বা মোট বিনিয়োগের স্থিতি কিন্তু কমেছে। এই বছর বিনিয়োগের স্থিতি কমে ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলারে নেমে এসেছে, যা ২০২১ সালে ছিল ২ হাজার ১৫৮ কোটি ডলার।

এদিকে বাংলাদেশকে নন–ইনভেস্টমেন্ট গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করেছে আঙ্কটাড। মুডি’স ইনভেস্টরস সার্ভিস গত মে মাসে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি রেটিং বি১ থেকে কমিয়ে বিএ৩ করার কারণেই মূলত আঙ্কটাড বাংলাদেশকে এই গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করে।

আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে সামগ্রিকভাবে এফডিআই প্রবাহ কমে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলারে নেমে আসে, যা আগের বছরের চেয়ে ১২ শতাংশ কম। মূলত রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা, উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণের কারণে এফডিআই প্রবাহ কমেছে।

সংস্থাটির মতে, উন্নত দেশগুলোতেই এফডিআই প্রবাহ সবচেয়ে কমেছে। এই দেশগুলোয় এফডিআই প্রবাহ ৩৭ শতাংশ কমে ৩৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার হয়েছে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এফডিআই বেড়েছে ৪ শতাংশ। অবশ্য সব উন্নয়নশীল দেশ সমানভাবে তা পায়নি।

আঙ্কটাড বলছে, গত বছরের তুলনায় গ্রিনফিল্ড বা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই তা বেড়েছে। ইলেকট্রনিকস, সেমিকন্ডাক্টর, অটোমোবাইলসহ যেসব খাত সরবরাহব্যবস্থার জটিলতার কারণে ভুগছিল, সেগুলোতেই সবচেয়ে বেশি গ্রিনফিল্ড বা নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা এসেছে।

বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে। তবে সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ বাড়লেও গতি কমেছে। যেমন ২০২১ সালে যেখানে এই দুই খাতে বিনিয়োগ বেড়েছিল ৫০ শতাংশ হারে, যা গত বছর কমে ৮ শতাংশে নেমেছে।

সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নে যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার, তা থেকে ঘাটতি ২০১৫ সালের চেয়ে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে, এমন উদ্বেগজনক তথ্য জানিয়ে সংস্থাটি টেকসই জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।

২০২২ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় সার্বিকভাবে এফডিআই বেড়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ভারত ৫ হাজার ৭৩৭ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। পাকিস্তানে এফডিআই গেছে ২১৫ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৩৮ শতাংশ কম। শ্রীলঙ্কায় এফডিআই বেড়েছে, অন্যদিকে নেপালে কমেছে।

জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এমনিতেই এফডিআইয়ের পরিমাণ অনেক কম। সে তুলনায় গত বছর কিছুটা ভালো এফডিআই এসেছে। দেখতে হবে, এখন নতুন বিনিয়োগ কতটা আসছে। যাঁরা এখানে অনেক দিন ধরে ব্যবসা করছেন, তাঁরা মুনাফার একটি অংশ আবার বিনিয়োগ করেন। সেটা এফডিআইয়ে দেখানো হয়। সে জন্য নতুন বিনিয়োগের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কীভাবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করা যায়, সেই ব্যবস্থা করা। দেশে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হয়েছে। এখন কীভাবে এক দরজায় সব সেবা দিয়ে বিদেশিদের সেখানে আকর্ষণ করা যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।