মালিকদের কৌশলেই কচ্ছপগতি

ছয় মাসের জন্য গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সময় প্রায় শেষ। নতুন করে এখন সময় বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।

পোশাকশিল্প
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকের মজুরি পুননি৴র্ধারণে ছয় মাস আগে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে সরকার। তিনটি বৈঠক আর ছয়টি কারখানা পরিদর্শন করেই ছয় মাস পার করে দিয়েছে এই বোর্ড। মালিক বা শ্রমিক কোনোপক্ষই এখনো তাদের মজুরি প্রস্তাব দেয়নি। ফলে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ প্রক্রিয়াটি প্রাথমিক পর্যায়েই আটকে আছে। এদিকে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ায় নতুন করে বোর্ডের সময় বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মালিকপক্ষের কৌশলের কারণে মজুরির আলোচনা ধীরগতিতে এগোচ্ছে। মূলত মজুরি প্রস্তাব বা নতুন মজুরি কাঠামো নিয়ে বড় ধরনের সমালোচনা কিংবা শ্রমিক আন্দোলন ঠেকাতেই এই কৌশল। পাঁচ বছর আগের সর্বশেষ মজুরি বোর্ডের সময়ও এই কৌশলে সফল হয়েছিল মালিকপক্ষ।

২০১৩ সালে মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের ৫ হাজার ১১৪ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিপরীতে মালিকপক্ষ ৬০০ টাকা মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। এ কারণে বড় ধরনের শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিল। তখন সড়ক অবরোধ ও কারখানা ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। মূলত ওই বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই মজুরিপ্রক্রিয়ায় ধীরগতিতে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিকপক্ষ।

মজুরি কাঠামোয় বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। তাই মজুরির পরিমাণ নির্ধারণের পাশাপাশি কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা দরকার। সে জন্য বর্ধিত সময়ে বোর্ডের ভেতরে ও বাইরে আলোচনার জন্য সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বেঁধে এগোনো দরকার।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

মালিকদের এই কৌশল বাস্তবায়নে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে মজুরি বোর্ডের একেকটি সভা করা হয়। সময়ক্ষেপণের অংশ হিসেবে কয়েকটি অঞ্চলে ছয়টি কারখানা পরিদর্শন করা হয়। এমনকি শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি যেন মজুরি প্রস্তাব না দেন, সেটিও মালিকপক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পোশাকশিল্পের মালিকদের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, নিম্নতম মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে শেষপর্যন্ত যে মজুরি নির্ধারণ হোক না কেন, তা একটি পক্ষ মানবে না। তারা শ্রমিকদের ইন্ধন দিয়ে মাঠে নামিয়ে পরিস্থিতি অশান্ত করার অপচেষ্টা করবে। সে জন্য মজুরি বোর্ডের আলোচনায় কিছুটা ধীরগতিতে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা।

মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান অবশ্য কৌশলে ধীরগতিতে এগোনোর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেখে–শুনে–বুঝে মজুরি প্রস্তাব দিতে চাই। হঠাৎ করে প্রস্তাব দিলে প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তা ছাড়া আমাদের হাতে সময় আছে। নতুন মজুরিকাঠামো কার্যকর হবে ১ ডিসেম্বর। আর সেই কাঠামোতে শ্রমিকেরা মজুরি হাতে পাবেন জানুয়ারিতে।’

এ বিষয়ে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে প্রতে৵ক পোশাকশ্রমিকই খুব কষ্টে আছেন। এমন পরিস্থিতিতে মজুরি নির্ধারণপ্রক্রিয়ায় ছয় মাসে কোনো অগ্রগতি না হওয়াটা শ্রমিকদের সঙ্গে একধরনের প্রহসন। তিনি আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো ঘোলাটে সময়ে মজুরিপ্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। যাতে শ্রমিকেরা সংগঠিত না হতে পারেন এবং মালিকেরা খেয়ালখুশি মতো মজুরি নির্ধারণ করতে পারেন।

চলতি বছরের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মজুরি বোর্ড গঠন করে। পরের মাসের ২৪ তারিখে বোর্ডের প্রথম সভা হয়। সেই সভা শেষে বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা মালিক ও শ্রমিকপক্ষকে পরবর্তী সভায় মজুরি প্রস্তাব দিতে অনুরোধ করেন।

আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে দ্বিতীয় সভা হলেও কোনোপক্ষই প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি। ওই সভা শেষে বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, উভয়পক্ষই পরবর্তী সভায় মজুরি প্রস্তাব দেবে বলেছে। গত ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত তৃতীয় সভায়ও মালিক ও শ্রমিক কোনো পক্ষই প্রস্তাব দেয়নি। 

‘প্রথম দিকে মজুরি বোর্ডের কার্যক্রমে ধীরগতি ছিল। তবে আজ (বৃহস্পতিবার) আমরা বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ একটি সভা করে দ্রুত প্রক্রিয়াটি শেষ করতে আমাদের প্রতিনিধিকে অনুরোধ করেছি। কারণ, সবাই মজুরি সম্পর্কে জানতে চায়।’
ফারুক হাসান, বিজিএমইএর সভাপতি

মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে আছেন সিরাজুল ইসলাম। ২০১৩ সালের মজুরি বোর্ডেও তিনি শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ছিলেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকার পরও কেন ছয় মাসে একটি মজুরি প্রস্তাব দিতে পারলেন না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সব শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের মত নিয়েছি। ইতিমধ্যে প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত করেছি। মজুরি বোর্ডের পরের সভায় আমি প্রস্তাব দেব।’

তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য প্রথম মজুরি বোর্ড গঠন করা হয় ১৯৯৪ সালে। তখন সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৯৩০ টাকা। এক যুগ পরে ২০০৬ সালে দ্বিতীয় মজুরি বোর্ড পোশাকশ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করে ১ হাজার ৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা। ২০১০ সালে গঠিত বোর্ড সেটি বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা করে।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর সমালোচনার মুখে মজুরি বোর্ড গঠন করে সরকার। সেই বোর্ডে মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৫ হাজার ৩০০ টাকা। আর সর্বশেষ বোর্ড পোশাকশ্রমিকের নিম্নতম মজুরি বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা করে।

ন্যূনতম মজুরি বোর্ডে ত্রিপক্ষীয় কাঠামোয় মজুরি নিয়ে আলোচনা হয়। যদিও কীভাবে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন নেই। সে জন্যই সময়ক্ষেপণের ঘটনা ঘটে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

এবার বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ২৩ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা মজুরি দাবি করছে। তাদের দাবির কাছাকাছি একটি প্রস্তাব দেবেন বলে প্রথম আলোকে জানান সিরাজুল ইসলাম।

অন্যদিকে মালিকপক্ষ কেমন প্রস্তাব দিতে পারে, সেই সম্পর্কে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর একাধিক নেতা জানান, সর্বনিম্ন গ্রেডে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। কারণ, গত পাঁচ বছরে সামগ্রিকভাবে ৩০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। যদিও গতবার মজুরি বেড়েছে ৫০ শতাংশ। এবারও ওই পরিমাণ বাড়তে পারে—এমন মনোভাবও আছে মালিকদের।

তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম দিকে মজুরি বোর্ডের কার্যক্রমে ধীরগতি ছিল। তবে আজ (বৃহস্পতিবার) আমরা বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ একটি সভা করে দ্রুত প্রক্রিয়াটি শেষ করতে আমাদের প্রতিনিধিকে অনুরোধ করেছি। কারণ, সবাই মজুরি সম্পর্কে জানতে চায়।’

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ন্যূনতম মজুরি বোর্ডে ত্রিপক্ষীয় কাঠামোয় মজুরি নিয়ে আলোচনা হয়। যদিও কীভাবে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন নেই। সে জন্যই সময়ক্ষেপণের ঘটনা ঘটে। শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়া করে প্রস্তাব দিয়ে আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়।

গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে আরও বলেন, মজুরি কাঠামোয় বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। তাই মজুরির পরিমাণ নির্ধারণের পাশাপাশি কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা দরকার। সে জন্য বর্ধিত সময়ে বোর্ডের ভেতরে ও বাইরে আলোচনার জন্য সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বেঁধে এগোনো দরকার।