ইইউর যে আইনের কল্যাণে পরিবর্তন আসতে পারে শ্রমিকের জীবনে

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অধিবেশনফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউরোপীয় সংসদে গতকাল করপোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেকটিভ পাস হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এই বিলটি আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক গৃহীত হওয়ার পথে আর একধাপ এগিয়ে গেল। শিল্প–কলকারখানায় মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার লঙ্ঘিত হলে যেসব ব্র্যান্ড সে কারখানাগুলোতে কার্যাদেশ দেয়, তাদেরও দায়ী করা যাবে—এটাই এই বিলের মূল প্রতিপাদ্য। এর মধ্য দিয়ে শ্রমিকের জীবনমানের উন্নতি হতে পারে।

বিষয়টি হলো এত দিন বাংলাদেশের মতো দেশের তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লাগলে বা শ্রমিকের অধিকার লঙ্ঘিত হরে মূল ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের দায় থাকত না। নতুন এই আইনের কারণে সেই পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। অর্থাৎ ব্র্যান্ডগুলো এখন দূর দেশের কারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তা, অধিকার ও পরিবেশগত অবনতির জন্য দায়ী থাকবে। তাদের এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে হবে।

দেশে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের সর্বশেষ মজুরিকাঠামো হওয়ার আগে থেকে ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন, ইন্ডাস্ট্রিঅলের মতো বৈশ্বিক সংগঠনগুলো শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির বিষয়ে সোচ্চার ছিল। এমনকি তারা ক্রেতাদের পোশাকের দাম বাড়ানো জন্য তাগিদ দিয়েছে। এবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই আইনের বলে শ্রমিকের জীবনমান ও সামগ্রিকভাবে কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নতির অবকাশ তৈরি হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

ফোর্বস ম্যাগাজিনের সংবাদে বলা হয়েছে, বিলটি পাস করানোর জন্য বেশ কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হয়েছে। অর্থাৎ মূল প্রস্তাবের যেসব ক্ষেত্রে কঠোর বিধিবিধান ছিল, সেসব ক্ষেত্রে কিছু শিথিলতা আনা হয়েছে। এই বিলটি শুধু কোম্পানির প্রত্যক্ষ কার্যক্রম নয়; একই সঙ্গে তার সাবসিডিয়ারি কোম্পানি ও সরবরাহব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে এটি গৃহীত হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতেও প্রভাব পড়বে।

এখন এই বিলটি ইউরোপীয় ইউনিয়নে গৃহীত হলে আগামী পাঁচ বছরে তা বাস্তবায়ন করা হবে। ২০২৭ সালে যেসব কোম্পানির কর্মীর সংখ্যা পাঁচ হাজার এবং যাদের বার্ষিক ব্যবসার পরিমাণ ১৫০ কোটি ইউরো, তারা এর আওতায় আসবে। এরপর ২০২৮ সালের মধ্যে যেসব কোম্পানির কর্মীর সংখ্যা তিন হাজার এবং যাদের বার্ষিক ব্যবসা ৯০ কোটি ইউরো, তারা এর আওতায় আসবে; ২০২৯ সালে আসবে সেই কোম্পানিগুলো, যাদের কর্মীর সংখ্যা এক হাজার এবং যাদের বার্ষিক ব্যবসা ৪৫ কোটি ইউরো।

রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন কারখানার নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী ইউনিয়নগুলোর প্রতিষ্ঠিত, বস্ত্র ও পোশাকশিল্পে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য আইনত বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি (দ্য ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকর্ড ফর হেলথ অ্যান্ড সেফটি ইন দ্য টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি) বা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকর্ডে আজ পর্যন্ত বিশ্বের দুই শতাধিক ব্র্যান্ড ও খুচরা ফ্যাশন পণ্য বিক্রেতা সই করেছে। ফলে সরবরাহকারীদের কারখানায় ৫৬ হাজারের বেশি স্বাধীন পরিদর্শন করা হয়েছে; ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি নিরাপত্তা সমস্যা সংশোধন করা হয়েছে এবং ২০ লাখ কর্মী স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।

এই বিলে নিয়ম লঙ্ঘনের শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে, যেমন কোনো কোম্পানি আইন ভঙ্গ করলে তার বার্ষিক নিট ব্যবসার ৫ শতাংশ জরিমানা করা হতে পারে।

এই বিলে বলা হয়েছে, সব শ্রমিকের নিরাপদ ও শোভন কর্মক্ষেত্রে কাজ করার অধিকার আছে। বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় বোঝা যায়, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা কতটা প্রয়োজনীয়। এই পরিস্থিতিতে ডিউ ডিলিজেন্স-সংক্রান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন প্রয়োজন; অর্থাৎ কারখানা যেখানেই হোক না কেন, এই সরবরাহব্যবস্থার দায় কোম্পানিগুলোকেও নিতে হবে।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামনে সুযোগ এসেছে; তারা চাইলে বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে, বিশেষ করে টেক্সটাইল খাতে। এই খাতে এখনো শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।