গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি দামের খড়গে উদ্যোক্তারা দুশ্চিন্তায় 

জানুয়ারিতে বিদ্যুতের দাম এক দফা বেড়েছে। আজ থেকে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে আবার। সঙ্গে গ্যাসের নতুন বাড়তি দামও কার্যকর হবে আজ থেকে। 

বিদ্যুতের দাম গত মাসে ইউনিটপ্রতি ৫ শতাংশ বেড়েছে। এরপর শিল্পভেদে গ্যাসের দাম ইউনিটপ্রতি ৮৭ থেকে ১৭৮ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সরকার। গতকাল নতুন করে আবারও বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ শতাংশ বৃদ্ধির ঘোষণা এসেছে। আজ বুধবার গ্যাস-বিদ্যুতের নতুন দাম কার্যকর হচ্ছে। ফলে ফেব্রুয়ারি মাসটি শুরু হচ্ছে উদ্যোক্তাদের বড় ধরনের দুশ্চিন্তায়। 

তিন সপ্তাহের মধ্যে দুই দফা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম এক দফা বাড়ানোয় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, জ্বালানির দাম দফায় দফায় বাড়ানোর কারণে তাঁরা চাপের মধ্যে পড়েছেন। পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। তাতে নতুন করে অনেক কোম্পানি লোকসানে চলে যাবে। আর যারা এরই মধ্যে লোকসানে চলে গেছে তাদের লোকসান আরও বাড়বে। পরিস্থিতি এমন যে টিকে থাকার কৌশল নির্ধারণেও এখন হিমশিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। 

আমরা শঙ্কায় আছি, ফেব্রুয়ারিতে আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে। দাম সমন্বয় মানে যদি হয় ৫ শতাংশ করে বৃদ্ধি, তাহলে বলার কিছু নেই।
মোহাম্মদ হাতেম, নির্বাহী সভাপতি, বিকেএমইএ

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। তাতে দেশে উৎপাদিত অনেক পণ্যের চেয়ে আমদানি করা পণ্য সস্তা হয়ে যেতে পারে। তার মানে দেশীয় পণ্য উৎপাদকেরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলোই বেশি ঝুঁকিতে থাকবে। তিনি আরও বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ে বাজারভিত্তিক কাঠামোর কথা বলছে সরকার। তবে বাজারভিত্তিক কাঠামোর বড় শর্ত হচ্ছে, ব্যয়ের ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন। অথচ আয় বাড়ানোর উদ্যোগ থাকলেও ব্যয় সাশ্রয়ের উদ্যোগ নেই। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম বেড়ে যায়। আবার দেশে দেখা দেয় ডলার–সংকট। তাতে খোলাবাজার বা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধের পাশাপাশি জ্বালানি তেল আমদানি কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তাতে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে শিল্পকারখানায় গ্যাসের সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। বেড়ে যায় বিদ্যুতের লোডশেডিং। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়, বেড়ে যায় উৎপাদন খরচ। 

এর আগে গত আগস্টে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম এক লাফে লিটারে ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা বৃদ্ধি করে জ্বালানি বিভাগ। সেই জেরে গত ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। আর গত ১৮ জানুয়ারি সার ও
চা-শিল্প ছাড়া অন্য সব শিল্পের জন্য গ্যাসের প্রতি ইউনিটের দাম ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তাতে গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় শিল্পের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম ইউনিটপ্রতি বাড়ছে সাড়ে ৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ছে এক লাফে ১৭৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। সেই রেশ না কাটতেই গতকাল আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। গ্যাস–বিদ্যুতের নতুন এ দাম আজ থেকে কার্যকর। 

জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী প্রতি মাসে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। আমরা শঙ্কায় আছি, ফেব্রুয়ারিতে আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে। দাম সমন্বয় মানে যদি হয় ৫ শতাংশ করে বৃদ্ধি, তাহলে বলার কিছু নেই। দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারণে শিল্পকারখানার লোকসানের পরিমাণ বাড়বে। তাতে একপর্যায়ে গ্যাস-বিদ্যুতের বিল না দেওয়ার কারণে অনেক কারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবে।’

পূর্বাচলে শীতলক্ষ্যার পারে কেপিসি ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানায় মাসে আড়াই কোটি পিছ পেপার কাপ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। কাপের পাশাপাশি থালা-বাটিও তৈরি হয় কারখানাটিতে। 

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কেপিসি ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী কাজী সাজেদুর রহমান বলেন, গত এক বছরে ব্যবসার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বেড়ে গেছে। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও দাম বাড়াতে পাচ্ছি না। সে কারণে গত মাসে ৩০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করতে হয়েছে। এখন দুই দফায় ১০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ল। তাতে লোকসান আরও বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা ব্যবসায়ীরা চরম হতাশ।

গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্যাসের দাম পুনর্নির্ধারণের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। চিঠিতে তিনি সব শিল্প খাতে গ্যাসের দাম ৫৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন দর আগামী এপ্রিল থেকে কার্যকর করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কামনা করেন।

জানতে চাইলে বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বস্ত্রকল কারখানায় গ্যাসের সংকট চলছে। এলএনজি আমদানি করতেও তো সময় লাগবে। তাই এলএনজি আমদানির পর গ্যাসের দাম বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীকে আমরা
অনুরোধ করেছি। সরকার সেটি বিবেচনা করছে বলেও আমাদের জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।’ 

রাজধানীর কোনাপাড়া এলাকায় শাহরিয়ার স্টিল কারখানায় দিনে ৩০০-৪০০ টন রড উৎপাদন হয়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম বলেন, বর্তমানে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কোনো কারখানার খরচ যদি দুই হাজার টাকা বাড়ে, তাহলে উৎপাদন খরচ বাড়বে পাঁচ হাজার টাকা। গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে শিগগিরই হয়তো প্রতি টন রডের দাম এক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

শেখ মাসাদুল আলম আরও বলেন, ব্যবসায়ীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে দাম সমন্বয় করা ঠিক নয়। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইস্পাতশিল্পের উদ্যোক্তারা চাপের মুখে আছেন। এখন অযৌক্তিকভাবে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ালে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।