বিক্রি কমেছে, দাম বেড়েছে

গত তিন মাসে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বিক্রি ৪০ শতাংশ ও নতুন গাড়ির বিক্রি ২০ শতাংশ কমেছে।

হঠাৎ গাড়ি বিক্রি কমে গেছে রাজধানীর বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্রে। কমেছে ক্রেতা উপস্থিতি। সম্প্রতি রাজধানীর বনানীর একটি বিক্রয়কেন্দ্রেছবি: প্রথম আলো

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল দেশের গাড়ির ব্যবসা। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি আর মূল্যস্ফীতির কারণে চলতি বছরের মে মাস থেকে প্রবৃদ্ধির গতি কমতে শুরু করে। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব। গাড়ি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ না নিলে আবারও বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন তাঁরা।

এ খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত দুই মাসে গাড়ির বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে ক্রেতার উপস্থিতি কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। আমদানি কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। আর গাড়ি বিক্রি কমেছে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। রাজধানীর বেশ কয়েকটি গাড়ির বিক্রয়কেন্দ্র ঘুরে এই তথ্য পাওয়া যায়।

রাজধানীর কাকরাইলে অবস্থিত স্টার কার হাউসের বিক্রয়কেন্দ্রে গতকাল সোমবার দুপুরে একজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলছিলেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা অংশীদার হামিদুল ইসলাম। এ সময় বেচাকেনার পরিস্থিতি জানতে চাইলে হামিদুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক মাস ধরে ক্রেতা একেবারেই কমে গেছে। আগে দিনে গড়ে ১০-১৫ ক্রেতা শোরুমে এসে গাড়ির খোঁজখবর নিতেন। এখন দিনে দুই-চারজনের বেশি ক্রেতার দেখা মিলছে না। এ ছাড়া আমরা অনলাইনে গাড়ি প্রদর্শন করি। সেখান থেকেও অনেকে খোঁজখবর নিতেন। এখন সেখান থেকে সাড়া কম।

রিকন্ডিশন্ড গাড়ি মধ্যবিত্তরাই বেশি কেনেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছেন। এতে বিক্রিতে ধাক্কা লেগেছে ।
আবদুল হক, সাবেক সভাপতি, বারভিডা

একই কথা জানালেন ওয়ালি কার প্যালেসের মালিক মো. ওয়ালিউল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, সব ধরনের পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে ক্রয়ক্ষমতার ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এ জন্য ক্রেতা কমেছে।

গাড়ির আমদানিকারক কোম্পানি কর্ণফুলী হুইলসের বিক্রয় ব্যবস্থাপক শামসুল আরেফিন জানান, গত দুই মাসে মাত্র ছয়টি গাড়ি বিক্রি হয়েছে। আগে মাসে সাত-আটটি গাড়ি বিক্রি হতো।

দেশে নতুন ও রিকন্ডিশন্ড গাড়ি—এই দুই ধরনের গাড়ি আমদানি ও বিক্রি হয়। তবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের কাছে রিকন্ডিশন্ড গাড়িই বেশি পছন্দ। জাপানে এক থেকে পাঁচ বছর চলার পর বাংলাদেশে আমদানি হয় এসব গাড়ি। দেশের গাড়ির বাজারের প্রায় ৭৫ শতাংশই রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দখলে।

রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) নেতারা জানিয়েছেন, বর্তমানে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বিক্রি বেশি কমেছে। গত তিন মাসে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বিক্রি ৪০ শতাংশ ও নতুন গাড়ির বিক্রি ২০ শতাংশ কমেছে।

রাজধানীর হকস বে অটোমোবাইল প্রায় ৫০ বছর ধরে গাড়ির ব্যবসা করছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও বারভিডার সাবেক সভাপতি আবদুল হক বলেন, আমাদের রিকন্ডিশন্ড গাড়ি মধ্যবিত্তরাই বেশি কেনেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণে তারাই সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছেন। এতে বিক্রিতে ধাক্কা লেগেছে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একদিকে কমেছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, অন্যদিকে বেড়েছে গাড়ির দাম। গত তিন-চার মাসে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে গাড়িভেদে দাম ৫ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে ক্রেতা বেশি ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা দামের গাড়ির। এসব গাড়ি দাম পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে অনিশ্চয়তা

ডলার-সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুন পর্যন্ত সব ব্যাংকের গাড়ি কেনা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি গাড়ি আমদানিতে শতভাগ এলসি মার্জিন আরোপ করেছে। অর্থাৎ গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে ঋণ সুবিধা বন্ধ করা হয়েছে।

গাড়ি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব সিদ্ধান্তের কারণে গাড়ি আমদানি ও বিক্রি হঠাৎ করে কমে গেছে। নতুন করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এ খাতে বড় অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। জ্বালানির দাম বাড়ায় গাড়ি বেচাকেনা আরও কমবে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

বারভিডার সভাপতি মো. হাবিব উল্লাহ বলেন, দেশে হোক বা বিদেশে, কোথাও কোনো স্বস্তির খবর নেই। গাড়ি আমদানি ও পরিবহনসহ সব ধরনের ব্যয় বেড়েছে। এখন জ্বালানির দাম বাড়ায় গাড়ির ব্যবসা নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক ক্রেতা এখন গাড়ি কিনতে চাইছেন না। তবে সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের দাম কমালে গাড়ির বিক্রিতে আবার গতি ফিরবে।

হাবিব উল্লাহ জানান, দেশে প্রায় ৯০০ ব্যবসায়ী গাড়ির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবসায়ী নগদ টাকায় গাড়ি আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারছেন। অন্যদের পক্ষে ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ৬৬০ সিসির গাড়ি আমদানি উৎসাহিত করতে সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমান নিয়মে দেশে পাঁচ বছরের পুরোনো গাড়ি আমদানি করা যায় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো গাড়ি আমদানির সুযোগ দেওয়ার দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি দুই হাজার সিসির নিচের গাড়ি আমদানির ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ মার্জিনের নিয়মে ছাড় দেওয়ার কথা বলেন।