বড় হচ্ছে দেশের বাজার, রপ্তানিও হচ্ছে

এ ব্যবসার সঙ্গে ধীরে ধীরে যুক্ত হচ্ছে দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপ। তবে চকলেটের বাজারের বড় অংশই এখনো বিদেশি চকলেটের দখলে।

নরসিংদীর পলাশে অবস্থিত প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে উৎপাদিত চকলেট মোড়কজাত করছেন কোম্পানির কর্মীরা
ছবি: প্রাণ গ্রুপের সৌজন্যে

আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। এ কারণে চকলেট ও সুগার কনফেকশনারির (চিনিজাতীয় মিষ্টি দ্রব্য) মতো পণ্যের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে দেশে দামি চকলেটের বাজার দ্রুত বড় হচ্ছে। পাশাপাশি চকলেট রপ্তানির সম্ভাবনাও বাড়ছে।

এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে চকলেট ও সুগার কনফেকশনারির বাজার প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে সুগার কনফেকশনারির হিস্যা প্রায় ৬৫ শতাংশ। আর বাকি অংশ চকলেটের। প্রতিবছর এই বাজার ১০–১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। এ ছাড়া একাধিক কোম্পানি রপ্তানি উপযোগী চকলেট উৎপাদন শুরু করেছে।

তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার–সংকট ও মূল্যস্ফীতির কারণে অন্যান্য খাতের মতো সাম্প্রতিক সময়ে চাপে পড়েছে চকলেট-ক্যান্ডির বাজারটিও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত এক বছরে ক্যান্ডি পণ্যের কাঁচামালের দাম ২০–৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এতে উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। এ কারণে চকলেট পণ্যের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ।

দেশে ক্যান্ডি ও চকলেট পণ্যের শীর্ষ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান বলেন, ‘কাঁচামাল সংগ্রহ করা বর্তমানে আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে চিনির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেশি অসুবিধায় পড়েছি। এ ছাড়া মোড়কজাতকরণসহ উৎপাদন ও বিপণনের বিভিন্ন পর্যায়েও খরচ বেড়েছে। কিন্তু সে অনুসারে আমরা দাম বাড়াতে পারিনি। ফলে পরিমাণ কমিয়ে দাম সমন্বয় করতে হচ্ছে।’

ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভালো ব্র্যান্ডের চকলেটের চাহিদাও বাড়ছে। কয়েক বছর ধরে চকলেটের চাহিদা ১০-১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে।
ইফতেখারুল ইসলাম দস্তগীর ব্যবস্থাপক, ই-কমার্স ও নতুন ব্যবসা বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (আইডিসি)

সুগার কনফেকশনারির বাজার বড়

শিশু–তরুণদের মধ্যে ক্যান্ডি বা লজেন্সের জনপ্রিয়তা রয়েছে বহু আগে থেকেই। এ ছাড়া ওয়েফার বা চুইংগামের চাহিদাও বেশি। অনেক সময় এক-দুই টাকা ভাংতি না থাকলে টাকার বদলে দোকানিরা এসব পণ্য দেন। ক্যান্ডি, লজেন্স, ওয়েফার, চুইংগাম প্রভৃতি সুগার কনফেকশনারি পণ্য।

বেশ কয়েকটি দেশীয় বড় শিল্পগোষ্ঠী ক্যান্ডি, ললিপপ, চুইংগাম, ওয়েফার ইত্যাদি সুগার কনফেকশনারি পণ্য তৈরি করছে। এদের মধ্যে প্রাণ-আরএফএল, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, পারটেক্স স্টার গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও আবুল খায়ের গ্রুপ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া এলসন, তিতাস ও মাদার ভরসা নামের কয়েকটি মাঝারি ও ছোট কোম্পানিও এসব পণ্য তৈরি করছে।

দেশীয় কোম্পানির পাশাপাশি ইতালির বহুজাতিক কোম্পানি পারফেটি ভ্যান মেল (পিভিএম) স্থানীয়ভাবে ক্যান্ডি ও চুইংগাম উৎপাদন করছে। পারফেটির পণ্যগুলোর মধ্যে এলপেনলিবে, মেন্টোস ও সেন্টার ফ্রুট বেশ জনপ্রিয়।

দেশে সুগার কনফেকশনারির বাজারে বড় অংশীদার প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান প্রাণ কনফেকশনারি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, দেশের অভ্যন্তরে বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ক্যান্ডি পণ্য বিক্রি করে তারা। এ ছাড়া বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ক্যান্ডি পণ্য রপ্তানি করে প্রাণ। প্রাণের ক্যান্ডি পণ্য অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, সিঙ্গাপুরসহ প্রায় ৮০টি দেশে রপ্তানি হয়।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশে বছরে ২০০ কোটি টাকার বেশি ওয়েফার–জাতীয় পণ্য বিক্রি হয়। এর প্রায় সবটাই দেশে তৈরি।

দামি চকলেটের চাহিদা বাড়ছে

চকলেট জারে ভরছেন কারখানার কর্মীরা।
প্রাণ গ্রুপের সৌজন্যে

ক্যান্ডি পণ্যের পাশাপাশি গত কয়েক বছরে দেশে দামি চকলেটের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। চকলেট তৈরি হয় কোকোবীজের গুঁড়া বা কোকো পাউডার থেকে। তবে বাংলাদেশে এই পণ্যের বাণিজ্যিক চাষ নেই। এ কারণে দেশে চকলেট পণ্যের বেশির ভাগ বিদেশ থেকে আসা চকলেটের দখলে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দামি চকলেটের মধ্যে ৭০ শতাংশ বিদেশ থেকে আসা চকলেট, বাকিটা দেশে তৈরি হচ্ছে। তবে বিদেশ থেকে আসা চকলেটের একটি বড় অংশই আসে বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশফেরত লোকজনের মাধ্যমে। ফলে এসব চকলেটের সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। বর্তমানে দেশে চকলেটের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যাডবেরি, কিটক্যাট, মারস, ফাইভ স্টার, বর্নভিল ইত্যাদি। আমদানিকারকেরা জানান, বাজারে ক্যাডবেরি ডেইরি মিল্কের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি মন্ডেলেজ ও ইতালির কোম্পানি ফেরেরোর চকলেট আমদানি করে ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (আইডিসি) বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, তাঁরা বছরে প্রায় দেড় শ কোটি টাকার চকলেট আমদানি করেন। আইডিসির আমদানি করা জনপ্রিয় চকলেট ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যাডবেরি, ফাইভ স্টার, বর্নভিলে, কিন্ডার জয় ইত্যাদি।

আইডিসির ই-কমার্স ও নতুন ব্যবসা বিভাগের ব্যবস্থাপক ইফতেখারুল ইসলাম দস্তগীর বলেন, ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভালো ব্র্যান্ডের চকলেটের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত কয়েক বছরে চকলেটের চাহিদা ১০-১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে।

মার্কিন বহুজাতিক চকলেট কোম্পানি মারসের এদেশীয় পরিবেশক ট্রান্সকম ডিস্ট্রিবিউশনস। তারা দেশে মারস, স্নিকারস, বাউন্টি, এমঅ্যান্ডএম ইত্যাদি ব্র্যান্ডের চকলেট আমদানি ও বিক্রি করে। চকলেটের আরেক বহুজাতিক ব্র্যান্ড নেসলে দেশীয় পরিবেশকের মাধ্যমে কিটক্যাট, মানচ, নেসলে ক্ল্যাসিক ও নেসলে মিলকিবার ইত্যাদি পণ্য বিক্রি করে। এগুলো মূলত ভারত ও দুবাই থেকে আসে।

তবে স্থানীয়ভাবে প্রাণসহ কয়েকটি কোম্পানি কাঁচামাল আমদানি করে চকলেট উৎপাদন শুরু করেছে। সম্প্রতি চকলেটের বাজারে প্রবেশ করেছে আরেক দেশীয় প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ। তারা ফ্রেশ চকলেট ব্র্যান্ড নামে চকলেট উৎপাদন শুরু করছে।

দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ

উৎপাদনের পর জারে চকলেট ভরছেন কর্মীরা
প্রাণ গ্রুপের সৌজন্যে

আমদানিকারকেরা বলছেন, প্রয়োজনীয় ঋণপত্র খুলতে না পারায় তাঁরা পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ–সংকট রয়েছে। এসব কারণে গত এক বছরে বিদেশি চকলেটের দাম প্রায় ৪০–৫০ শতাংশ বেড়েছে।

স্থানীয়ভাবে চকলেট ও ক্যান্ডি পণ্য প্রস্ততকারকেরাও এ সংকটের কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, ঋণপত্র খুলতে না পারায় কাঁচামাল আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। এ ছাড়া ময়দা, তেল, চিনিসহ সব ধরনের কাঁচামালের দামও বেড়ে গেছে। এ কারণে পণ্য উৎপাদনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। 

শুল্ক–কর ফাঁকি নিয়ে অভিযোগ

আমদানিকারকেরা অভিযোগ করেছেন, অনানুষ্ঠানিক বা শুল্ক–কর ফাঁকি দিয়ে বিপুল পরিমাণ চকলেট দেশে আসে। এসব চকলেটের বড় অংশই আসে বিদেশফেরত যাত্রীদের হাত ধরে। যার বড় অংশই বিক্রি হয় গুলশানের ডিসিসি মার্কেটে। শুল্ক–কর ছাড়াই এসব চকলেট দেশে আসে। ফলে আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে আমদানি করা চকলেটের আমদানিকারকেরা অসব প্রতিযোগিতায় পড়েন।