বড় বাণিজ্যকেন্দ্রে রূপ নিচ্ছে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল

বেশ কয়েক বছর পর কেউ যদি হঠাৎ করে গুলশান অ্যাভিনিউতে পা রাখেন, তাহলে নিঃসন্দেহে অবাক হবেন। কারণ, অ্যাভিনিউর সড়কের দুই পাশে দৃষ্টিনন্দন বহুতল ভবন আর ভবন। গত দেড় দশকে মতিঝিলের পর গুলশান অ্যাভিনিউ বড় বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। এখানেই নিজেদের প্রধান বা আঞ্চলিক কার্যালয় স্থানান্তর করেছে দেশের অধিকাংশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, করপোরেট প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক কোম্পানি ও দেশীয় শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক শিল্পগোষ্ঠী।

গুলশান অ্যাভিনিউর দুই পাশের অধিকাংশ প্লটেই ইতিমধ্যে বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। তা ছাড়া গুলশানের বড় অংশজুড়ে রয়েছে আবাসিক ভবন। ফলে বাণিজ্যকেন্দ্রটি আর সম্প্রসারণের সুযোগ খুব একটা নেই। তাই বলে সব থমকে যাবে, তা তো নয়। বাণিজ্যিক কেন্দ্রের ঢেউ এসে লেগেছে এখন তেজগাঁও-গুলশান সংযোগ সড়কে। ইতিমধ্যে সেখানে দেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার বাণিজ্যিক ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। পাশাপাশি গড়ে উঠছে আরও বেশ কিছু বহুতল ভবন। কয়েকটি বহুতল ভবন আগে থেকেই আছে। সেখানে রয়েছে দেশি-বিদেশি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। পাশাপাশি পোশাক, গাড়ি, আসবাবের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে। রেস্তোরাঁর সংখ্যাও বাড়ছে। নির্মিত হচ্ছে একটি পাঁচ তারকা হোটেল। হাসপাতালও রয়েছে। হাতিরঝিলের কারণে যোগাযোগব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে। আপাতত তেজগাঁও-গুলশান সংযোগ সড়ক ঘিরেই নতুন বাণিজ্যকেন্দ্র সম্প্রসারিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল হয়ে উঠেছে দেশের বড় বাণিজ্যিক এলাকা।

পঞ্চাশের দশকে জমি অধিগ্রহণ করে ৫০০ একর ২০ শতাংশ জায়গার ওপর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হয়। সেখানে মূল প্লট ও উপপ্লটের সংখ্যা ৪৩০। শিল্পাঞ্চল হলেও তেজগাঁওয়ে ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল না। পরিবর্তনশীল অবস্থার প্রেক্ষাপটে ১৯৯৮ সালে তেজগাঁও-গুলশান সংযোগ সড়ককে ‘বাণিজ্যিক সড়ক’ ঘোষণা করে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শিল্পাঞ্চলের চরিত্র পাল্টে শিল্প-বাণিজ্য-আবাসন—এই তিনের মিশেলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলকে গড়ে তোলার অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তারপরই দ্রুতই পরিবর্তন হতে থাকে এলাকাটি।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের পরিবর্তন

পঞ্চাশের দশকে শিল্পাঞ্চলকে শহর থেকে দূরে রাখতেই তেজগাঁও নিয়ে মহাপরিকল্পনা করে তৎকালীন সরকারের পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট। ১৯৫৯ সালের ঢাকার প্রথম মাস্টার প্ল্যানেও তেজগাঁও শিল্প এলাকার কথা উল্লেখ ছিল। সে অনুযায়ী ৪৭৩ একর ৬৮ শতাংশ জমি অধিগ্রহণসহ মোট ৫০০ একর ২০ শতাংশ জমিতে গড়ে তোলা হয় তেজগাঁও শিল্প এলাকা। ১৯৬৮ সালে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) এখানে হালকা শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। তৎকালীন মহাপরিচালক, কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের দপ্তর শিল্পাঞ্চলের প্লট বরাদ্দ দেয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে।

২০১৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, ২০০৫ সাল পর্যন্ত শিল্পাঞ্চলটির মোট জমির ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশে শিল্পকারখানা ছিল। তারপর থেকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালের দিকে শিল্প ও বাণিজ্যিক কাজে জমির ব্যবহার প্রায় সমান হয়ে যায়। তখন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের ৪৩০টি প্লটের ১৪১টি শিল্প, ১৪৭টি বাণিজ্যিক, ৬১টি প্রাতিষ্ঠানিক, ৬১টি আবাসিক ও ২০টি সেবামূলক খাতে বরাদ্দ ছিল। ওই সময় শিল্পাঞ্চলের মোট ভবনের ৩৮ শতাংশ ছিল ১ থেকে ২ তলা। আর ৩৯ শতাংশ ভবন ছিল ৩ থেকে ৫ তলা। ১৯ শতাংশ ভবন ছিল ৬ থেকে ৯ তলা উচ্চতার। আর ১০ তলার বেশি ভবন ছিল মাত্র ৪ শতাংশের মতো।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ২৭ একর জমিতে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ১১ একর জমিতে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, ১৬ একরের বেশি জায়গাজুড়ে রয়েছে কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদাম (সিএসডি) ও ৮ একর জমিতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসি) গড়ে তোলা হয়েছে। তার বাইরে বিএসটিআইসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্লট রয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে কোহিনূর কেমিক্যাল, নাবিস্কো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি, কল্লোল গ্রুপ, ইনসেপ্টা, ঢাকা ব্রেড ফ্যাক্টরি, ঊর্মি গ্রুপের অ্যাটায়ার্স ম্যানুফ্যাকচারিং কোং লিমিটেড, আকিজ, মেঘনা বাইসাইকেল, শার্প ব্লেডসহ বিভিন্ন কোম্পানির শিল্পকারখানা ছিল। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই বর্তমানে ঢাকার আশপাশের এলাকায় তাদের কারখানা স্থানান্তর করেছে। তার পরিবর্তে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে গড়ে উঠছে বাণিজ্যিক ভবন।

বাঁয়ের ৪০ তলা ভবনটি বর্তমান নির্মাণ করছে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আবাসন প্রতিষ্ঠান শান্তা হোল্ডিংস। তারপরের ভবনটির (টুইন টাওয়ার, নাম ফোরাম) নির্মাণকাজ ইতিমধ্যে শেষ করেছে শান্তা। তার পাশের শান্তা ওয়েস্টার্ন টাওয়ার এক দশক আগের। রাজধানীর তেজগাঁও–গুলশান সংযোগ সড়কে
ছবি: শান্তা হোল্ডিংসের গ্রাফিকস

এ জন্য অবশ্য সরকার নীতিসহায়তাও দিয়েছে। ২০১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শিল্পাঞ্চলের চরিত্র পাল্টে শিল্প-বাণিজ্য-আবাসন—এই তিনের মিশেলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলকে গড়ে তোলার অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পরে তৎকালীন মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের নির্দেশে প্রথম পর্যায়ে স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতির নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি পরিকল্পনার খসড়া তৈরির কাজ শুরু করে। ২০১৬ সালের ২০ জুন এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই শিল্পাঞ্চলের জমি শিল্প, বাণিজ্যিক ও আবাসিক প্লট হিসেবে রূপান্তর করা হয়। ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত হওয়া তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের রূপান্তরিত প্লটসংক্রান্ত খসড়া বিধিমালায় সুউচ্চ বাণিজ্যিক ভবন করার সুযোগ রাখা হয়।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর–পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের কাছে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে যতগুলো বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি চাওয়া হচ্ছে, তার সব কটি ২০-২৫ তলার ওপরে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ প্লটেই যদি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয় তাহলে সেখানকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে। পরিবেশের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমনকি তেজগাঁওয়ের যানজট ঢাকার ফুসফুস হিসেবে পরিচিত হাতিরঝিলের সুফলকে বিনষ্ট করবে।

নতুন বাণিজ্যকেন্দ্রের রূপান্তর

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ঢাকা ব্রেইড ফ্যাক্টরির প্লটে ৩২ তলা বাণিজ্যক ভবন নির্মাণ করবে নেক্সটিয়ন নামের আবাসন প্রতিষ্ঠান।
ছবি: নেক্সটিয়নের গ্রাফিকস

গুলশান অ্যাভিনিউর দিক থেকে তেজগাঁও-গুলশান সংযোগ সড়কে প্রবেশ করতেই সুইসটেল নামের একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করছে বেঙ্গল গ্রুপ। সেখান থেকে কিছুটা সামনে এগোলেই কয়েকটি পোশাকের ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্র। নাভানা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির নির্মাণাধীন ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন এইচআর টাওয়ার। তারপর কয়লা নামের একটি রেস্তোরাঁ, নাভানা সিএনজি, টয়োটা ও নিশান গাড়ির বিক্রয়কেন্দ্র পার হলেই হাতিরঝিল সংযোগ সড়ক। তার বাঁ পাশ থেকেই মূলত তেজগাঁও শিল্প এলাকা শুরু।

এ শিল্পাঞ্চলে আকিজ গ্রুপ তাদের নিজস্ব প্লটে বহুতল ভবন নির্মাণ করে প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছে। তার কয়েকটি প্লট পরেই ৪৫ কাঠা জমির ওপর ৪০ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করছে দেশের শীর্ষস্থানীয় আবাসনপ্রতিষ্ঠান শান্তা হোল্ডিংস। নাম পিনাকেল। এটিই হতে যাচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার ভবন। তার ঠিক পাশের প্লটে ৯০ কাঠা জমিতে ২৪ তলা দুই ভবন নির্মাণ করেছে শান্তা হোল্ডিংস। এই বাণিজ্যিক ভবন দুটি ওপরের দিকে সংযোগ রয়েছে। এটি দেশের প্রথম টুইন টাওয়ার। ফোরাম নামের এই ভবনে এরই মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশ তাদের কার্যালয় স্থানান্তর করেছে।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের যে প্লটে ফোরাম গড়ে উঠেছে, সেটির মালিকানায় রয়েছে মেঘনা করপোরেশন। এই প্লটেই একসময় বাইসাইকেল সংযোজনের কারখানা ছিল, দেশের শীর্ষস্থানীয় এই বাইসাইকেল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের। তবে গাজীপুরে নতুন কারখানা করার পর তেজগাঁওয়ের কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এই ৩২ তলা বহুতল বাণিজ্যিক ভবনটি নির্মান করছে ইনস্টার গ্রুপ। ইতিমধ্যে কাজ অনেক দূর এগিয়েছে
ছবি: গ্রাফিকস, ইনস্টার

মেঘনা করপোরেশনের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) লুৎফুল বারি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহু আগেই আমরা কারখানা গাজীপুরে স্থানান্তর করি। প্রথম আমরা নিজেরাই নিজেদের কোম্পানির কার্যালয় করার জন্য ভবন নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম। পরে শান্তার হোল্ডিংসের সঙ্গে যৌথভাবে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেছি।’

ফোরামের পাশের প্লটের ৬০ কাঠা জমিতে দেড় দশক আগে শান্তা হোল্ডিংস নির্মাণ করে শান্তা ওয়েস্টার্ন টাওয়ার। এটি তেজগাঁও-গুলশান সংযোগ সড়কে প্রথম বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। ২০১১ সালে ১৪ তলা এই ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়। এই ভবনেই বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি, নিউজিল্যান্ড ডেইরি, কাতার এয়ারওয়েজের মতো প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে। একটি ভবনের নিচে শিগগিরই চালু হবে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড বিএমডব্লিউ গাড়ির বিক্রয়কেন্দ্র।

শান্তা হোল্ডিংসের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক (সেলস অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস) শিহাব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানকার বড় সুবিধা হচ্ছে প্লটের আকার বড়, যা ঢাকার অন্য কোনো এলাকায় পাওয়া যায় না। তাই বহুতল ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে। গুলশান-তেজগাঁও সংযোগ সড়ক ছাড়াও ভেতরের এলাকার সড়কগুলোও প্রশস্ত। এ এলাকায় প্রবেশ ও বের হওয়ার অনেকগুলো পথ রয়েছে। গুলশানের কাছাকাছি হওয়ায় বনানী, বারিধারা ও বসুন্ধরা থেকে আসা খুবই সহজ। তা ছাড়া ব্যাংক, চিকিৎসালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, বাজার, শপিংসহ অনেক কিছুই হাতের কাছে। ফলে আগামী দিনের বাণিজ্যকেন্দ্র হতে যাচ্ছে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল।

সংযোগ সড়ক ধরে মহাখালীর দিকে এগোলেই র্যাংগস ব্যাবিলয়না। এখানে মোবাইল ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিম্ফোনির প্রধান কার্যালয়। তারপর কয়েকটি প্লট পরেই ইম্পেটাস লাউঞ্জ নামের বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। এই ভবনেই বিশ্বখ্যাত অডি গাড়ির বিক্রয়কেন্দ্র। আরেকটু সামনে গেলেই গলি সড়কের মুখে এরিস্টোফার্মা নির্মাণ করছে ১৩ তলা উচ্চতার বাণিজ্যিক ভবন।

এতক্ষণ সড়কের এক পাশের কথা বলছিলাম। আরেক পাশও পিছিয়ে নেই। যদি ওই পাশটা তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের অংশ নয়। তাতে কী। সড়কের উভয় পাশ নিয়ে গড়ে উঠছে নতুন এই বাণিজ্যকেন্দ্র। আকিজ হাউসের উল্টো পাশে পোশাকের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড আড়ং নতুন করে বিশাল বিক্রয়কেন্দ্র করেছে। সামনে বিশাল পার্কিংয়ের জায়গা রেখে দোতলা প্রি ফেব্রিকেডের ভবনে আড়ংয়ের বিক্রয়কেন্দ্রটি তাদের অন্য যেকোনো বিক্রয়কেন্দ্রের চেয়ে অনন্য।

আড়ংয়ের পরই রয়েছে একটি গলিপথ। সেখানেই আসবাবের ব্র্যান্ড হাতিলও বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেছে। তার পরপরই ২ হাজার ৭ বর্গমিটার আয়তনের জমির ওপর আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান ইনস্টার নির্মাণ করছে ৩২ তলা বহুতল ভবন। ট্রেড ইন্টারকন্টিনেন্টাল নামের ভবনটি জমির মালিকানায় রয়েছে হাউস অব সানশাইন নিটওয়্যার লিমিটেড। তার পাশেই লালবাগ মেটাল ইন্ডাস্ট্রির জমিতে নির্মিত হচ্ছে ১৫ তলার আরেকটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। গলি পেরিয়ে আবার মূল সড়কে উঠতেই দুই পাশে হুন্দাই, হোন্ডা, মাহিন্দ্রাসহ বিভিন্ন নামীদামি ব্র্যান্ডের গাড়ির বিক্রয়কেন্দ্র চোখে পড়বে। তারপর রয়েছে সেনাকল্যাণ বিজনেস মার্ট নামে নয়তলা বাণিজ্যিক ভবন। ২০ কাঠা জমির ওপর ভবনটি নির্মাণ করেছে সেনাকল্যাণ সংস্থা। আশপাশেই রয়েছে পারটেক্স ফার্নিচারের বিক্রয়কেন্দ্র। শান্তা ওয়েস্টার্ন টাওয়ারের উল্টো পাশের গলিতে অনিক টাওয়ারে ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। গলির মুখে দ্য গ্যারেজ নামে এক রেস্তোরাঁর ভেতরে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ফুডকোর্ট। বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই গ্যারেজে ভিড় করেন বেশি।

সংযোগ সড়ক ধরে আরও কিছুটা এগোলেই চোখে পড়বে নির্মাণাধীন বহুতল বাণিজ্যিক ভবন সিটিজেন টাওয়ার। ৩০ কাঠা জমির ওপর নির্মাণাধীন ভবনটি হবে ১৬ তলা। পাশেই ইপিলিয়ন গ্রুপের বিখ্যাত নিনাকাব্য ভবন।

নিনাকাব্যের উল্টো দিকের গলির মুখেই এরিস্টোফার্মার ভবনটি হচ্ছে। গলিতে ঢুকতেই নাসরিন টাওয়ার। তার উল্টো পাশেই সুপ্রিম ইম্পোর্টসের দোতলা ভবন। বাঁ পাশের গলি দিয়ে এগোলেই কর্ণফুলী ওয়ার্কশপ ও এসিআই মোটরসের কার্যালয়। তার উল্টো পাশেই সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ চলছে। ৪ একর জমির ওপর এই ক্যাম্পাস গড়ে উঠছে। দুটি বেজমেন্ট ছাড়া ১১ তলা ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। আগামী জানুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ভবনে কার্যক্রম শুরু করবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি।

জানতে চাইলে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির পরিচালক মো. ইমতিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৫ সালে কোহিনূর কেমিক্যালের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জমিটি কিনে নেয়। তারপর ২০০৯ সালে এখানকার চারতলা পুরোনো ভবনে ক্লাস পরীক্ষা চলছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার বাধ্যবাধকতার কারণেই ২০১৮ সালে নতুন ভবন নির্মাণ শুরু হয়।

আরেকটু সামনে এগোতেই চোখে পড়ল মল্লিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল করপোরেশনের প্লট। সেখানে একটি শেডের নিচে বেশ কিছু গাড়ি রাখা রয়েছে। তার উল্টো পাশে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীন রহিম মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এই পর্যায়ে হাঁটা বাদ দিয়ে রিকশা নিলাম পুরো এলাকা ঘুরে দেখতে। রিকশাচালক বয়স্ক লোকটিকে বললাম, ‘চাচা প্যাডেলে চাপটা আস্তে...।’

ঢাকা ব্রেড ফ্যাক্টরির প্লটে এন এইচ টাওয়ার নামে ৩২ তলা ভবন হচ্ছে। নেক্সটিয়ন ডেভেলপমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান ভবনটি নির্মাণ করছে। লাভ রোডে নতুন করে নির্মিত হয়েছে সওজ (সড়ক ও জনপথ ভবন)। পাশে জাহাজের আদলে বহুতল ভবন হচ্ছে। আহসান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় বেশ আগে থেকেই আছে। বছর কয়েক আগে হয়েছে এম এইচ শমরিতা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ। তারপরই জাতীয় নাক, কান গলা ইনস্টিটিউট। এ সড়কের আরও সামনে গেলে পোশাক ও বস্ত্র খাতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান নিউ এশিয়া গ্রুপের বহুতল বাণিজ্যিক ভবন।

জানতে চাইলে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র মতিঝিল যানজটসহ নানা কারণে ইতিমধ্যে গুরুত্ব হারিয়েছে। সেই চাপটা এসে পড়েছে গুলশান অ্যাভিনিউ, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ, বনানী ১১ সড়কে। তাতে আবাসনের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। ফলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল নতুন বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে, এটি খুবই ইতিবাচক। বর্তমানে এখানে যে গতিতে বহুতল ভবন নির্মাণকাজ চলছে তাতে আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে পুরো এলাকার চেহারাই বদলে যাবে।’

আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, ‘তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। যাতে করে যানজট সৃষ্টি না হয়। বিদ্যুৎ, পানি ও পয়োনিষ্কাশন নিয়েও যাতে ঝামেলায় পড়তে না হয়। এই এলাকার বাসিন্দাদের জন্য ছোট পার্ক করা দরকার। পাশাপাশি তেজগাঁওয়ে যেসব বস্তি আছে, সেগুলো নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে। তাদের জন্য আশপাশেই স্বল্প মূল্যের আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই আধুনিক ও পরিকল্পিত একটি নতুন বাণিজ্যকেন্দ্র পাব আমরা।’