মালিকের স্বস্তি, শ্রমিকের অস্বস্তি

ডলার শক্তিশালী ও টাকা দুর্বল হওয়ায় মালিক ও শ্রমিকের ওপর বিপরীতধর্মী প্রভাব পড়েছে।

পাঁচ মাস আগেও ডলারের আনুষ্ঠানিক দর (বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দাম) ছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা। বর্তমানে সেটি বেড়ে হয়েছে ৯৫ টাকা। তবে বৈদেশিক মুদ্রাটির সংকটের কারণে ব্যাংকে আরও বেশি দামে কেনাবেচা হচ্ছে ডলার। ফলে পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত প্রতি ডলারের বিপরীতে ১০-১৫ টাকা পর্যন্ত আয় বেড়েছে মালিকদের। যদিও বিদ্যুতের লোডশেডিং, চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়া ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ কিছুটা বেড়েছে এ খাতের কারখানাগুলোর।

অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার-সংকট ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দফায় দফায় বাড়ছে। গণপরিবহনের ভাড়াও বেড়েছে। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পোশাকশ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমে যাচ্ছে। তাতে বর্তমান মজুরিতে শ্রমিকদের জীবনযাপন করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

গত জুনের শুরুর দিকে মজুরি বাড়াতে আন্দোলনে নামেন ঢাকার বিভিন্ন কারখানার পোশাকশ্রমিকেরা। তখন আন্দোলন থামাতে মালিক, শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে টানা দুই দিন ত্রিপক্ষীয় সভা হয়। সেই সভা থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠনের আশ্বাস দেওয়া হয়। তারপর দুই মাস পার হলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। তৈরি পোশাক খাতে সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর নতুন মজুরিকাঠামো বাস্তবায়ন হয়। সেই কাঠামোতে ন্যূনতম মজুরি ছিল ৮ হাজার টাকা।

বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের টিকে থাকার জন্য নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন অথবা মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার দাবি করছেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রমিকেরা যে কষ্টে আছেন, সেটি স্বীকার করলেও এখনই মজুরি বাড়াতে চান না মালিকপক্ষ। তাঁদের দাবি, ডলারের কারণে যতটুকু আয় বেড়েছে তার চেয়ে খরচ বেড়েছে বেশি। পোশাক ক্রয়াদেশও তুলনামূলক কম।

নিম্নতম মজুরিকাঠামোর নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিবছর শ্রমিকের মূল মজুরি ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করেন মালিকেরা। অথচ তিন মাস ধরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। গত জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তাতে জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এদিকে গত ৬ আগস্ট থেকে জ্বালানি তেলের দাম ৪২-৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। তারপর নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম আরেক দফা বেড়েছে।

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ক্রয়াদেশের অভাবে সক্ষমতার অন্তত ৩০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছে না কারখানাগুলো। গ্যাস–বিদ্যুতের সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। চলমান ক্রয়াদেশও স্থগিত হচ্ছে। অনেক কারখানা শ্রমিকের মজুরি দিতে ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে যেটুকু বাড়তি আয় হচ্ছে, তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না।

মূল্যস্ফীতির চাপে শ্রমিকেরা

প্রথম আলোর গাজীপুর প্রতিনিধি মাসুদ রানা গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকজন পোশাকশ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেন। প্রত্যেকেই বলেছেন, নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে সংসার চালানো সম্ভব না।

গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকার একটি কারখানায় কাজ করেন মরিয়ম খাতুন। মজুরি পান ৮ হাজার টাকা। দেড় মাস ধরে ওভারটাইম না থাকায় আয় কমেছে তাঁর। মরিয়ম বললেন, ‘তিন হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিই। বাকি পাঁচ হাজার টাকায় তিনজনের সংসার চালাতে হয়। কয়েক মাস আগেও কষ্ট করে চলতে পারতাম। এখন আর সেটা পারছি না। বাজারে সবকিছুর আগুন দাম।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৯ সালের নগর আর্থসামাজিক অবস্থা নিরূপণ জরিপে একজন মানুষের গড় খাবার ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ করা হয়। সেই খাদ্যতালিকার মধ্য থেকে সাধারণ ২০টি খাবারের দাম বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে হিসাব করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) চার পরিবারের মাসিক খরচের হিসাবটি দাঁড় করিয়েছে। এ ক্ষেত্রে গত ৩০ মে বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবির) পণ্যমূল্য বিবেচনায় নিয়েছে তারা।

সিপিডির তথ্যানুযায়ী, ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বসবাসরত একজন ব্যক্তির মাসিক খাবার খরচ ৫ হাজার ৩৩৯ টাকা। চারজনের একটি পরিবারের ক্ষেত্রে এই খরচ হচ্ছে ২১ হাজার ৩৫৮ টাকা। যদি কোনো পরিবার পুরো মাসে একবারও মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস ও মুরগি না খায় তাহলেও খরচ ৮ হাজার ১০৬ টাকা। এ খরচের মধ্যে খাবারের সঙ্গে এক কক্ষের ঘরভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল, চিকিৎসা ব্যয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার পণ্য ক্রয়, সন্তানের পড়ালেখার খরচ, যাতায়াত, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের বিল আছে।

শ্রমিকনেতা বাবুল আক্তার বলেন, শ্রমিকেরা ভালো নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় খাবারের ঘাটতিতে আছেন শ্রমিকেরা। এমনিতেই তাঁরা মাছ-মাংস কম খেতেন। বর্তমানে সেটি আরও কমে গেছে। আবার আগে যাঁরা বাসে করে কারখানায় যেতেন, তাঁরা হেঁটে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের ধরে রাখতে হলে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করতে হবে। অথবা মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করতে হবে। এ ছাড়া তাদের ভর্তুকিমূল্যে নিত্যপণ্য দিতে বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া উচিত সরকারের।

মালিকদের আয় কত বাড়ল

১০০ ডলারের পোশাক রপ্তানি করলে তার মধ্যে ৭০-৭৫ শতাংশ চলে যায় কাঁচামাল আমদানিতে। বাকি ২৫-৩০ শতাংশ অর্থ দিয়েই শ্রমিকের মজুরি, কর্মকর্তাদের বেতন, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে হয় মালিকদের। সব ধরনের খরচ মিটিয়ে শেষ পর্যন্ত গড়ে ২-৫ শতাংশ মুনাফা হয়। বর্তমানে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মালিকদের আয় প্রায় তিন শতাংশ বেড়েছে (প্রতি ডলার ১০ টাকা বাড়তি ধরে)।

জানতে চাইলে প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, দিনে গড়ে ২-৩ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। ডিজেল জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন সচল রাখতে লাখ টাকার মতো খরচ পড়ছে। আবার গ্যাসের চাপ কম থাকায় ডায়িংয়ের সময় কাপড় নষ্ট হচ্ছে। পরিবহন খরচও বেড়েছে। সব মিলিয়ে খরচ ৬-৭ শতাংশ বেড়েছে। তার বিপরীতে ডলারের কারণে আয় বেড়েছে মাত্র দুই থেকে আড়াই শতাংশ।

এদিকে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে গত অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে কারখানাগুলো। এই আয় তার আগের বছরের তুলনায় ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। পোশাক রপ্তানির ওপর ভর করেই দেশের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের মাইলফলকে পৌঁছায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে রপ্তানি হয়েছে ৩৩৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক, যা গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি।

ডলার শক্তিশালী হওয়ায় মালিকদের আয় বেড়েছে। তাহলে শ্রমিকের মজুরি বাড়াতে সমস্যা কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তরে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর শ্রমিকের মজুরি ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করছি। তার বাইরে দক্ষ শ্রমিকেরা ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি পাচ্ছেন। ডলারের কারণে মালিকদের আয় কিছুটা বাড়লেও বিদ্যুতের লোডশেডিং ও গ্যাসসংকট এবং জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৮-১০ শতাংশ। আবার ক্রয়াদেশ কমেছে ২০-৩০ শতাংশ। তাই আপাতত মজুরি বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।’

অবশ্য মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রমিকেরা যে কষ্টে আছেন, সেটি স্বীকার করলেন মোহাম্মদ হাতেম। বললেন, ‘শ্রমিকদের কষ্ট লাঘবে রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আশা করি, সরকারি পর্যায়ে এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ডলারসহ নানা কারণে পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের আয়-ব্যয় ওঠানামা করছে। আবার মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভারসাম্যপূর্ণ উদ্যোগ প্রয়োজন। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মালিকেরা যে বাড়তি আয় করছেন, তার এক–চতুর্থাংশ অর্থ দিয়েই শ্রমিকদের সাময়িকভাবে বাড়তি ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়া সম্ভব। তাহলে শ্রমিকেরা বর্তমান কঠিন সময়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন।