রাজধানীতে নিজের একটি বাড়ির স্বপ্ন দেখেন না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে সাধ আর সাধ্যের ফারাক মেলাতে পারছেন না অধিকাংশ মানুষ। তারপরও অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটের চাহিদা প্রতিবছরই বাড়ছে। নতুন নতুন আবাসন প্রকল্প নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আবাসন–সংশ্লিষ্ট রড, সিমেন্ট, রং ও আসবাবসহ প্রায় আড়াই শ খাত–উপখাতের ব্যবসা।
দেশের প্রথম মেট্রোরেল রাজধানীতে চালু হচ্ছে ২৮ ডিসেম্বর। সেটিকে কেন্দ্র করে উত্তরা তৃতীয় পর্যায়ের প্রকল্পে নতুন নতুন আবাসিক ভবন গড়ে উঠছে। আশপাশের এলাকায় আরও প্রকল্প নেওয়ার সুযোগও তৈরি হয়েছে। পূর্বাচলও ধীরে ধীরে আবাসন প্রকল্পের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তাতে আবাসন খাতের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। যদিও একের পর এক চ্যালেঞ্জও যুক্ত হচ্ছে এই খাতে। তাতে সংকটের আশঙ্কাও করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সংগঠনটির সক্রিয় সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮০০। তারা বছরে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট সরবরাহ করে। যদিও রিহ্যাবের সদস্য নয়, এমন প্রতিষ্ঠানও আছে এ খাতের ব্যবসায়।
২০২০ সালে করোনার প্রথম ঢেউয়ে প্রথম দেড়–দুই মাস আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা প্রায় স্থবির ছিল। তারপর দ্রুতই আবার তা ঘুরে দাঁড়ায়। তবে গত বছর নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে গেলে আবারও দুশ্চিন্তা ভর করে এ খাতে। তখন লোকসান থেকে বাঁচতে অধিকাংশ কোম্পানিই অ্যাপার্টমেন্ট বা বাণিজ্যিক স্পেস বা জায়গার দাম বাড়িয়ে দেয়। সেই রেশ কাটতে না কাটতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। তাতে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হয়। ডলার–সংকটে পড়ে দেশ। ডলারের দামও অনেক বেড়ে যায়। তাতে আরেক দফা নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ে।
জানতে চাইলে বিল্ডিং ফর ফিউচারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীরুল হক বলেন, ‘ঢাকায় গত বছর প্রতিটি ইট কিনেছি সাড়ে আট টাকায়। এখন দাম ১৫–১৭ টাকা। প্রতি টন রডের দাম ৫৩ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৮৭ হাজার টাকা হয়েছে। ৩৫০–৩৭৫ টাকার সিমেন্টের বস্তা ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সে জন্য ফ্ল্যাটের দাম এলাকাভেদে প্রতি বর্গফুটে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়াতে হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডলার–সংকটের কারণে জেনারেটর ও লিফট আমদানিতেও জটিলতার মধ্যে পড়ছি।’
এদিকে নির্মাণসামগ্রীর দামের অস্থিরতার মধ্যেই ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ অনুমোদন করা হয়। নতুন ড্যাপ অনুযায়ী উত্তরা, মিরপুর–১১, বাউনিয়া, পাইকপাড়া, কল্যাণপুর, জোয়ারসাহারা, কুড়িল, খিলক্ষেত, কালাচাঁদপুর, কড়াইল, মেরুল বাড্ডা, রামপুরা, উলন, নিকেতন, নয়াটোলা, মধুবাগ, গোড়ান, সিপাহীবাগ, মধ্য বাসাবো, আনসারাবাদ, সবুজবাগ, কদমতলা, দক্ষিণগাঁও, মালিবাগ, শান্তিবাগ, শুক্রাবাদ, পশ্চিম রাজাবাজার, জিগাতলাসহ কিছু এলাকায় নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে উচ্চতা আগের চেয়ে কমবে। বর্তমানে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, উত্তরায় তিন কাঠার একটি প্লটে সর্বোচ্চ সাততলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন নির্মাণ করা যায়। নতুন ড্যাপ অনুযায়ী, সেখানে সর্বোচ্চ ছয়তলার বেশি ভবন নির্মাণ করা যাবে না।
আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন ড্যাপে ভবনের উচ্চতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। ঢাকার মধ্যাঞ্চল অর্থাৎ ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, ইস্কাটন, মালিবাগ, বেইলি রোড, শান্তিনগরসহ অনেক এলাকায় আগের চেয়ে কম উচ্চতার ভবন নির্মাণ করতে হবে। ফলে গত চার মাসে এসব এলাকায় নতুন কোনো প্রকল্প নিতে পারেনি কোম্পানিগুলো। ইতিমধ্যে নির্মাণসামগ্রীর দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আবার নতুন ড্যাপের কারণে ভবনের উচ্চতা কমবে। এই দুই মিলে আবাসন খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে বলে খাত–সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা। তাঁদের মতে, এতে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়বে। তার প্রভাবে বাসাভাড়াও বেড়ে যাবে।
জানতে চাইলে রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইতিমধ্যে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম দুই হাজার টাকা করে বেড়ে গেছে। নতুন ড্যাপের প্রভাবে ফ্ল্যাটের দাম আরও বাড়বে। তবে কতটা বাড়বে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। আমাদেরও আসলে ধারণা নেই।’
রিহ্যাবের সভাপতি আরও বলেন, ‘আমরা শুনতে পাচ্ছি, রাজউকের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন থেকেও ভবনের নকশার অনুমোদনের শর্ত আসছে। আবার জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি না রাখার কথাও শোনা যাচ্ছে। এমনটা হলে আবাসন ব্যবসা করা কঠিন হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনীতিতে আবাসন খাতের গুরুত্ব অনেক। তাই নীতির কারণে এই খাত যেন ক্ষতির মুখে না পড়ে, সে বিষয়ে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।