ভোটের বছরে চাহিদা বাড়ার আশা

গত মৌসুমে চায়ের চাহিদা ছিল কম। এর মূল কারণ দুধ–চা তৈরির উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি।

চায়ের চুমুকে ভাটার টান চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। তবে এই খরা খুব দ্রুত কেটে যাবে বলে আশা করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। কারণ, চায়ের চলতি মৌসুমে (এপ্রিল-মার্চ) জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চায়ের চাহিদায় চাঙাভাব থাকবে বলে আশা তাঁদের। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চায়ের চাহিদায় ভাটা তৈরি হওয়ার মূল কারণ দুধ–চা তৈরির উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে চিনির দাম ৬১ শতাংশ বেড়ে কেজিপ্রতি ১২০-১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার গুঁড়া দুধের দাম বেড়েছে ১৭ থেকে ২৯ শতাংশ। বেড়েছে কনডেন্সড মিল্কের দামও।

চা–কোম্পানিগুলো বলছে, বিশেষায়িত ব্র্যান্ড ছাড়া সাধারণ প্যাকেটজাত চায়ের দাম সাম্প্রতিক সময়ে বাড়েনি। শুধু উপকরণের দাম বাড়ায় হোটেল-রেস্তোরাঁ ও চা- দোকানে প্রতি কাপ চায়ের দাম বেড়েছে। আবার বাসাবাড়ি ও অফিসে চা তৈরিতেও এখন বাড়তি খরচ হচ্ছে। যেমন এখন গুঁড়া দুধ দিয়ে তৈরি চা প্রতি কাপ ১২ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫ টাকা। কনডেন্সড মিল্কের চা–ও বিক্রি হচ্ছে প্রতি কাপ ১০-১২ টাকা। চা–পানের চাহিদায় এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

আবার মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য না হলে সেখানে কাটছাঁট করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অন্য পণ্যের দাম বাড়ায় চায়ের চাহিদা চাঙা হতে পারছে না বলে চা–কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা মনে করছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে আজ রোববার তৃতীয়বারের মতো জাতীয় চা দিবস পালন করা হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘চা দিবসের সংকল্প, শ্রমিকবান্ধব চা শিল্প।’ বাংলাদেশ চা বোর্ডের উদ্যোগে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। ১৯৫৭ সালের ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসেবে তৎকালীন চা বোর্ডে চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চা–শিল্পে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০২১ সাল থেকে দিনটি চা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

নিলামে বিক্রি কমেছে ৩ শতাংশ

চায়ের নিলাম মৌসুম শুরু হয় এপ্রিল থেকে। চলে পরবর্তী বছরের মার্চ পর্যন্ত। বাগানে উৎপাদিত চা এপ্রিল-মার্চ মৌসুমে চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলের দুটি নিলামকেন্দ্রে বেচাকেনা হয়। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশ বিক্রি হয় চট্টগ্রামের নিলামে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ মৌসুমে নিলামে চা বিক্রি হয়েছে ৯ কোটি ১৪ লাখ কেজি। সদ্য শেষ হওয়া ২০২২-২৩ মৌসুমে বিক্রি হয় ৮ কোটি ৮৭ লাখ কেজি চা। অর্থাৎ ২০২১-২২ মৌসুমের তুলনায় গত মৌসুমে নিলামে চা বিক্রি কমেছে ৩ শতাংশ। নিলামে ছাড়াও বাগান থেকে সরাসরি চা সংগ্রহ করে বাজারজাত করতে পারে কোম্পানিগুলো। প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ কেজি চা এভাবে সংগ্রহ করা হয়।

গত এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া চলতি ২০২৩-২৪ মৌসুমের নিলামেও চা বিক্রি আগের তুলনায় কম। যেমন ন্যাশনাল ব্রোকারেজ লিমিটেডের নিলাম প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মৌসুমের প্রথম পাঁচটি নিলামে চা বিক্রি হয়েছে ৪৭ লাখ ৯১ হাজার কেজি চা। এর আগে ২০২২-২৩ মৌসুমে একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ৫২ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা। অর্থাৎ চায়ের বিক্রি কমেছে সাড়ে ৮ শতাংশ।

মূলত দেশে যত চা বাজারজাত করা হয়, তার ৯৬-৯৭ শতাংশই নিলাম থেকে কেনা। নিলাম থেকে চা কেনার পরিমাণ কমে যাওয়ার অর্থ বাজারে চাহিদা কম। কোম্পানিগুলো যেসব চা কিনছে, তা সব বাজারজাত করা হচ্ছে ধরে নিলেও গত মৌসুমে চায়ের চাহিদা কমেছে। 

চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে পাইকারি চা–বিক্রেতা অংকুর টি হাউসের কর্ণধার মো. সায়েম প্রথম আলোকে বলেন, চায়ের বিক্রি কিছুটা কমেছে। দুটো কারণে এটা হতে পারে। এক. চা তৈরিতে পাতার ব্যবহার কমিয়েছে স্টলগুলো। দুই. সংসারের খরচ কমিয়ে মানুষ চা–পানের পরিমাণও কমাতে পারে। 

চা কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা জানান, মোটাদাগে তিন খাতে চা বিক্রি হয়। এই তিনটি হলো চায়ের স্টল ও ভ্রাম্যমাণ দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং বাসাবাড়ি ও অফিস। চায়ের স্টল ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ চা ব্যবহৃত হয়। বাসাবাড়ি ও অফিসে ৪৫ শতাংশ। চায়ের ভোগ বেশি কমেছে হোটেল-রেস্তোরাঁয়।

চা কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা জানান, চায়ের ভোক্তা কমেনি। চা যেহেতু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়, সে জন্য অনেকে চা পান কমিয়ে দিয়েছেন। দিন শেষে চা বিক্রিতে এর প্রভাব পড়েছে।

খুব বেশি বাড়েনি আমদানি

চা বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালে চায়ের উৎপাদন কমেছে। আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৭ লাখ কেজি কমে উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৩৮ লাখ কেজি। উৎপাদন কমলেও আমদানি খুব বেশি বাড়াতে হয়নি।

রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে দেখা যায়, ২০২১ সালে চা আমদানি হয়েছে ৯ লাখ ৪১ হাজার কেজি। গত বছর উৎপাদন কমার পরও আমদানি হয়েছে ১০ লাখ কেজি। এ হিসাবে আমদানি বেড়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। আমদানির তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, চা আমদানি করছে মূলত প্যাকেটজাত কোম্পানিগুলো। এই চা আমদানি হচ্ছে উন্নত মানের চা তৈরিতে। বড় কোম্পানিগুলো প্যাকেটজাত চা তৈরিতে নানা জায়গায় চা মিশিয়ে নতুন ব্র্যান্ডের নামে প্যাকেটজাত করে। এ জন্যই কিছু পরিমাণ চা আমদানি করে তারা।

লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটির ‘অ্যানুয়াল বুলেটিন অব স্ট্যাটিসটিকস ২০২২’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চা আমদানি হয়েছিল ২০১৩ সালে। ওই বছর বাংলাদেশে ১ কোটি ১৬ লাখ কেজি চা আমদানি হয়। ২০১৫ সালেও ১ কোটি কেজি চা আমদানি হয়।

চা উৎপাদকেরা জানিয়েছেন, চলতি বছরের শুরুতে খরার পরও চা উৎপাদন গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে চা উৎপাদন হয়েছে ৭৬ লাখ কেজি। গত বছর একই সময়ে উৎপাদন হয় ৭০ লাখ কেজি। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় চা উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ বা পাঁচ লাখ কেজির বেশি। চায়ের উৎপাদন বাড়লে বাড়তি চা রপ্তানির সুযোগ আছে।

বাড়ার আশা নির্বাচনে

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইতিমধ্যে মেয়র নির্বাচন শুরু হয়েছে। বছর শেষ বা আগামী বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। নির্বাচনের সময় ঘরের বাইরে চায়ের আড্ডা জমে ওঠে। চায়ের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে তাতে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের দুই মাসে চা বিক্রি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছিল। নির্বাচনী প্রচারে সব পক্ষ সরব থাকলে সে সময় চা বিক্রি আরও বাড়ত বলে বিপণনকারীরা জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি শাহ মঈনুদ্দিন হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাহিদা কমে যাওয়ার বিষয়টি সাময়িক। এটি নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই আমাদের। কারণ, নির্বাচনের মৌসুম শুরু হচ্ছে। চায়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে এ সময়।’