ঘটা করে উদ্বোধন, এখনো ফাঁকা পড়ে আছে রাসায়নিক গুদাম

পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে শ্যামপুরের উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জমিতে সারি সারি রাসায়নিক গুদাম তৈরি করা হয়েছে। যদিও উদ্বোধনের পর দেড় মাস পার হলেও রাসায়নিক গুদামগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। গত সোমবার রাজধানীর শ্যামপুরে।ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর শ্যামপুরে অস্থায়ীভাবে বানানো রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম গত ৪ জুন উদ্বোধন করা হয়। এরপর দেড় মাসের বেশি সময় পার হলেও রাসায়নিক গুদাম চালু হয়নি। পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে শ্যামপুরের উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জমিতে এই গুদাম তৈরি করা হয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গুদামের সংখ্যা কম ও ভাড়া বেশি হওয়ার কারণে তাঁরা রাসায়নিক গুদাম ব্যবহারে আগ্রহ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে কর্তৃপক্ষ আশা করছে, তারা ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক গুদামগুলোকে পুরান ঢাকা থেকে শ্যামপুরে সরিয়ে নিতে পারবে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। এর ঠিকাদার ছিল নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস।

২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর গুদাম নির্মাণের কাজ শুরু হয়, যা ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে করোনা সংকটসহ নানা কারণে প্রকল্পের মেয়াদ গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রকল্পটিতে মোট খরচ হয়েছে ৫৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

রাজধানীর শ্যামপুরে অস্থায়ীভাবে বানানো রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম গত ৪ জুন উদ্বোধন করা হয়। এরপর দেড় মাসের বেশি সময় পার হলেও রাসায়নিক গুদাম চালু হয়নি।
ছবি: প্রথম আলো

ভাড়া দিতে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বিসিআইসি

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস গত ৪ জুন রাসায়নিক গুদাম বেশ ঘটা করেই উদ্বোধন করেন। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিসিআইসি গুদাম বুঝে পায় ১৮ জুলাই। পরদিন রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও ভাড়া প্রদান নীতিমালা ২০২২ অনুযায়ী গুদাম ও তৎসংলগ্ন অফিস কক্ষ ভাড়া দেওয়ার বিষয়ে বিসিআইসি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তাতে আগ্রহীদের ২৪ জুলাই থেকে ২৪ আগস্ট সময়ের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়। এরপর আবেদন মূল্যায়ন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান বাছাই করে দুই বছরের জন্য গুদাম ভাড়া দেওয়ার কথা জানানো হয়।

বিসিআইসির কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্প বুঝে নিতে কিছুটা দেরি হওয়ায় এবং গুদামের ভাড়া নির্ধারণসহ অন্যান্য প্রাথমিক কাজ শেষ হতে কিছুটা সময় লেগেছে। তাই ব্যবসায়ীরা এখনো গুদাম বরাদ্দ পাননি।

বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘গুদাম ভাড়া দেওয়ার সব প্রস্তুতি ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। আশা করছি, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে গুদামগুলো চালু করা সম্ভব হবে।’

আরও পড়ুন

আবেদনের সময় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স, বিস্ফোরক পরিদপ্তর বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতিপত্র, ইলেকট্রনিক কর শনাক্তকরণ নম্বর (ইটিআইএন) ও ভ্যাট নিবন্ধন নম্বরসংক্রান্ত নথি জমা দিতে বলা হয়। এর সঙ্গে বিসিআইসি চেয়ারম্যানের অনুকূলে এক লাখ টাকার ব্যাংক ড্রাফট ও ছয় মাসের গুদাম ভাড়া জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়।

আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের অবস্থান হতে হবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায়। রাসায়নিক পণ্য আমদানি, বিপণন, সরবরাহ বা পাইকারি অথবা খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে আবেদনকারীর কমপক্ষে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইমপোর্টার অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ও পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ অ্যাসিড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হতে হবে। তবে এসব সমিতির সমস্যা নয়, এমন ব্যবসায়ীরাও গুদামের জন্য আবেদন করতে পারেন।

আরও পড়ুন

কী আছে অস্থায়ী গুদামে

গত সোমবার (২৪ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শ্যামপুরে প্রায় ছয় একর জায়গায় মোট ৫৪টি গুদামঘর গড়ে তোলা হয়েছে। একেকটির আয়তন ১ হাজার ৪৪৪ বর্গফুট। সেখানে দুটি অফিস ভবন, বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, মসজিদ, গভীর নলকূপ, পানির ট্যাংকসহ কিছু স্থাপনা রয়েছে। প্রতি তিনটি গুদামঘরের মাঝে একটি করে ফায়ার হাইড্রেন্ট (আগুন নেভানোর পানির কল)। এ ছাড়া ৬০টির বেশি সিসি ক্যামেরা দিয়ে পুরো এলাকার ওপর সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।

বিসিআইসির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন বিভাগের পরিচালক মো. জাকির হোসেন আখন্দ প্রথম আলোকে জানান, সব গুদাম ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে। এখন ভাড়াচুক্তি সম্পন্ন হলেই সেগুলো ব্যবহার করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।

বর্তমানে ব্যবসায়ীদের ভাড়া ও পরিষেবা মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৪০-৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। সে তুলনায় অস্থায়ী গুদামের ভাড়া অনেক বেশি। যাঁরা বেশি ভাড়া দিয়ে পোষাতে পারবেন, তাঁরা হয়তো সেখানে যাবেন।
আরিফ হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বিসিপিএমএ

আগ্রহ কম ব্যবসায়ীদের

আলাপকালে ব্যবসায়ীরা জানান, এই অস্থায়ী গুদাম ব্যবহারে তাঁরা তেমন আগ্রহী নন। কারণ, রাসায়নিক পণ্যের ব্যবসায়ীর তুলনায় গুদামের সংখ্যা অনেক কম। ফলে বিচ্ছিন্নভাবে সেখানে গিয়ে লোকসানের মুখে পড়তে হতে পারে বলে আশঙ্কা তাঁদের। এর চেয়ে তাঁরা মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে নির্মিতব্য রাসায়নিক পল্লিতেই যাওয়ার বিষয়ে বেশি আগ্রহী।

বাংলাদেশ অ্যাসিড ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি হারুন-আল-রশিদ বলেন, ‘অ্যাসিড পণ্য অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। এ ছাড়া আমাদের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে রাসায়নিক পল্লিতে যেতে আগ্রহী।’  

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিপিএমএ) সাবেক সভাপতি নুরুল মোস্তফা বলেন, শ্যামপুরে অস্থায়ী গুদামের সংখ্যা অপর্যাপ্ত। আর ব্যবসায়ীরা সাধারণত এক জায়গায় থাকতে পছন্দ করেন। এ কারণে অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে শ্যামপুরে যেতে আগ্রহী নন।

সংগঠনটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের মধ্যে অতি দাহ্য পণ্য নিয়ে ব্যবসা করেন, এমন ব্যবসায়ী রয়েছেন দুই শতাধিক। তাঁদের অধিকাংশই চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পরে ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন স্থানে গুদাম সরিয়ে নিয়েছেন। ফলে যাঁরা এখনো গুদাম সরাতে পারেননি, তাঁরা হয়তো শ্যামপুরে যেতে পারেন।’

বাংলাদেশ রাসায়নিক আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের সমিতির সদস্যরা যেসব রাসায়নিক পণ্যের ব্যবসা করেন, সেগুলোর ৯০ শতাংশই অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তাই যাঁদের রাসায়নিক পণ্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তাঁদের শ্যামপুরে গুদাম বরাদ্দ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

এ বিষয়ে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমরা গুদাম ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। এখন দেখি কেমন সাড়া পাই। প্রয়োজনে পরবর্তীতে সিটি করপোরেশনের সহায়তায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ গুদামগুলোকে পুরান ঢাকা থেকে শ্যামপুরে সরিয়ে নেওয়া হবে।’  

শিল্প মন্ত্রণালয় ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরামর্শ নিয়ে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন ব্যবসায়ীদের আপত্তি পেলে গুদাম ভাড়া পর্যালোচনার সুযোগ আছে। তবে গুদামের বিষয়ে ভালো সাড়া পেলে ভাড়া পুনর্বিবেচনা করা হবে।
মো. সাইদুর রহমান, চেয়ারম্যান, বিসিআইসি

ভাড়া নিয়ে আপত্তি

বিসিআইসির বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী গুদাম ও অফিসের আয়তন ১ হাজার ৪৪৪ বর্গফুট হলেও গুদামের সামনের খোলা জায়গা, নিরাপত্তাচৌকি, বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, গভীর নলকূপ, পানির ট্যাংক ইত্যাদিসহ মোট ২ হাজার ৫৬ বর্গফুট জায়গার ভাড়া দিতে হবে ব্যবসায়ীদের। প্রতি বর্গফুটের মাসিক ভাড়া ৭০ টাকা করে। সে অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠানকে মাসে প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ, পানি, নিরাপত্তাসহ অন্যান্য পরিষেবার জন্য আরও ২০ হাজার টাকার বেশি বিল আসতে পারে। সব মিলিয়ে মাসে খরচ দাঁড়াতে পারে কমবেশি ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এই ভাড়াকে অনেক বেশি বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা।

বিসিপিএমএর সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন বলেন, বর্তমানে ব্যবসায়ীদের ভাড়া ও পরিষেবা মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৪০-৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। সে তুলনায় অস্থায়ী গুদামের ভাড়া অনেক বেশি। যাঁরা বেশি ভাড়া দিয়ে পোষাতে পারবেন, তাঁরা হয়তো সেখানে যাবেন।

এ নিয়ে জানতে চাইলে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয় ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরামর্শ নিয়ে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন ব্যবসায়ীদের আপত্তি পেলে গুদাম ভাড়া পর্যালোচনার সুযোগ আছে। তবে গুদামের বিষয়ে ভালো সাড়া পেলে ভাড়া পুনর্বিবেচনা করা হবে।