দেশেই তৈরি হচ্ছে মোটরসাইকেলের হেলমেট

  • দেশে বছরে হেলমেটের চাহিদা ৩ লাখের বেশি।

  • প্রাণ-আরএফএলের কারখানায় উৎপাদনক্ষমতা ১ লাখ ২০ হাজারটি।

  • প্রাথমিক বিনিয়োগ ২০ কোটি টাকা।

প্রাণ গ্রুপের কারখানায় তৈরি হচ্ছে হেলমেট
সংগৃহীত

দেশে বছরে মোটরসাইকেলের হেলমেট বিক্রি হয় তিন লাখের বেশি। এত দিন চাহিদার প্রায় পুরোটা আমদানি করে মেটানো হতো। এখন দেশেই হেলমেট উৎপাদন শুরু হয়েছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএলের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আরএফএল প্লাস্টিকস লিমিটেড নরসিংদীর ঘোড়াশালে প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে হেলমেট তৈরির কারখানা করেছে। কারখানাটিতে উৎপাদনও শুরু হয়েছে।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ বলছে, শিগগিরই মোটরসাইকেলের সরঞ্জাম বিক্রির দোকানগুলোতে তাদের হেলমেট পাওয়া যাবে। দেশে উৎপাদনের ফলে হেলমেটের দাম কমবে। কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে। আবার বিদেশে রপ্তানির সুযোগও রয়েছে।

হেলমেট উৎপাদন ও বাজারজাতের জন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) ছাড়পত্র নিতে হয়। চলতি মাসের শুরুতে এই ছাড়পত্র পেয়েছে প্রাণ-আরএফএল। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে কারখানায় হেলমেট উৎপাদন শুরু হয়।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে সাশ্রয়ী দামে দেশীয় মানসম্পন্ন হেলমেট গ্রাহকদের দিতে চাই।’

বড় বাজার, প্রথম কারখানা

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশে মোটরসাইকেল বিক্রি প্রতিবছর বাড়ছে। সর্বশেষ ২০২২ সালে বিক্রি হয় প্রায় ৫ লাখ ৮৮ হাজার মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেলের সঙ্গে হেলমেটের বাজারও বড় হচ্ছে। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী, মোটরসাইকেলচালক ও আরোহীর মানসম্মত হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক।

দেশের বাজারে প্রায় ২০টি ব্র্যান্ডের অর্ধশতাধিক মডেলের হেলমেট পাওয়া যায়। তবে সব হেলমেট মানসম্পন্ন নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হেলমেটের নামে যা বিক্রি হয়, তা প্লাস্টিকের বাটির মতো। এসব হেলমেট ২০০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা দামে পাওয়া যায়।

ভালো মানের হেলমেট পলিকার্বনেট, গ্লাস ও কার্বন ফাইবার ইত্যাদি উপকরণে তৈরি। বৈশ্বিক সংস্থা বা বহুজাতিক কোম্পানির মান যাচাই করা (সার্টিফায়েড) এসব হেলমেট বিক্রি হয় ২ থেকে ১০ হাজার টাকা দামে। অবশ্য কোনো কোনো বিশেষ ধরনের ও ব্র্যান্ডের হেলমেটের দাম আরও বেশি।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ বলছে, তাদের কারখানাটি বিএসটিআইয়ের ছাড়পত্র পাওয়া প্রথম কারখানা। এতে প্রাথমিকভাবে প্রায় ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। কারখানায় বছরে ১ লাখ ২০ হাজার হেলমেট উৎপাদন করা হবে, যা দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ।

প্রাণ-আরএফএলের হেলমেটের ব্র্যান্ড নাম সেফমেট। মাথা ও মুখমণ্ডল ঢাকা (ফুল কভার) এবং শুধু মাথা ঢাকা (হাফ কভার) দুই ধরনের হেলমেটই তৈরি করছে প্রাণ-আরএফএল। একেকটি হেলমেটের দাম পড়বে মানভেদে ১ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ২ হাজার ২৫০ টাকার মধ্যে। একই মানের আমদানি করা হেলমেটের তুলনায় সেফমেট ব্র্যান্ডের হেলমেটের দাম বেশ কিছুটা কম পড়বে বলে দাবি প্রাণ-আরএফএলের কর্মকর্তাদের।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান বলেন, ‘সুরক্ষা সরঞ্জাম হিসেবে যতটা মান বজায় রাখা দরকার, সেটা আমরা নিশ্চিত করছি। ভবিষ্যতে আমাদের হেলমেট রপ্তানির পরিকল্পনা আছে। এ জন্য হেলমেটের আন্তর্জাতিক সত্যায়নের জন্যও আমরা শিগগিরই প্রক্রিয়া শুরু করব।’

বিএসটিআইয়ের কড়াকড়ি

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ মোটরসাইকেলচালক অথবা আরোহী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মারা যাওয়া ব্যক্তির মাথায় হেলমেট থাকে না। থাকলেও তা নিম্নমানের।

হেলমেটের মানদণ্ড রয়েছে। বিএসটিআই গত বছরের অক্টোবরে হেলমেটের মান চূড়ান্ত করে। এরপর সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মোটরসাইকেল হেলমেট উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রির ক্ষেত্রে মানসনদ থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়।

বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেশন মার্কস শাখার সহকারী পরিচালক খালিদ রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশ থেকে আসার পর কাস্টমস থেকেই পণ্যের (হেলমেট) নমুনা পরীক্ষা করে ছাড়পত্র দেয় বিএসটিআই। ফলে এখন মানসম্পন্ন হেলমেট আমদানি বেড়েছে। এ ছাড়া দোকান পর্যায়ে নিম্নমানের হেলমেট বিক্রি বন্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।

গত সপ্তাহে তিন দিন রাজধানীর বংশাল, মিরপুর-১০ ও বাংলামোটরের মোটরসাইকেল সরঞ্জাম বিক্রির দোকান ঘুরে দেখা যায়, অহরহ নিম্নমানের ও বিএসটিআই অননুমোদিত হেলমেট বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা বলেছেন, বেশির ভাগ নিম্নমানের হেলমেট আমদানি করা। কিছু নিম্নমানের হেলমেট দেশেও তৈরি হয়।

এ বিষয়ে বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তা খালিদ রেজা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সতর্ক থাকছি। এরপরও ফাঁকি দিয়ে নিম্নমানের কিছু হেলমেট দেশে প্রবেশ করে থাকতে পারে। আবার কিছু হেলমেট আগে আনা হতে পারে। তবে দেশের মধ্যে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়া কেউ মোটরসাইকেলের হেলমেট বানাচ্ছে কি না, তা জানা নেই।’

প্রাণের কারখানায় উৎপাদিত হচ্ছে সেফমেট ব্র্যান্ডের হেলমেট
সংগৃহীত

আমদানি কমেছে, দাম বেড়েছে

আমদানিকারকেরা বলেছেন, গত কয়েক মাসে প্রয়োজন অনুসারে ঋণপত্র খুলতে না পারায় হেলমেট আমদানি প্রায় ৩০ শতাংশের মতো কমেছে। বিপরীতে দাম বেড়েছে ২৫-৩০ শতাংশ। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না থাকায় বাজারে হেলমেটের চাহিদাও কিছুটা কমেছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ভারত ও চীনে তৈরি হেলমেট। এ ছাড়া ফ্রান্স, স্পেন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশ থেকেও কিছু হেলমেট আসে। আগে দেশে চীনের হেলমেটই বেশি পাওয়া যেত। এখন ভারত থেকে আমদানি বেড়েছে।

দেশে হেলমেট আমদানি করতে মোট করভার প্রায় ৫৯ শতাংশ। মানে হলো, ১০০ টাকা আমদানিমূল্য হলে তার ওপর ৫৯ টাকা শুল্ককর দিতে হয়। দেশে হেলমেট তৈরি করলে তুলনামূলক কম দামে বিক্রির সুযোগ রয়েছে।

স্থানীয়ভাবে ভালো মানের হেলমেট তৈরির উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন আমদানিকারকেরা। হেলমেট আমদানিকারক মো. আবুল আয়েস খান প্রথম আলোকে বলেন, এটা অবশ্যই ভালো। তবে দেশে তৈরি হেলমেটের ভালো মান যেন সব সময় নিশ্চিত করা হয়। আর একাধিক কোম্পানি এই খাতে এলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে। এতে মান বৃদ্ধির পাশাপাশি দামও কমে আসবে।