‘জাদুর জিনি’র প্রতারণার জাদুতে গ্রাহকেরা

লোভনীয় ছাড়ে পণ্য বিক্রির ফাঁদ। ফাঁদে পা দিয়ে ভুক্তভোগী ২৩ ব্যক্তি ৩৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। মামলা হওয়ায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে মালিকপক্ষ।

‘যাপিত জীবন আরও সহজ করতে দেশে এল “জাদুর জিনি”। চাল-ডাল থেকে শুরু করে কসমেটিকস, ইলেকট্রনিকস পণ্য, গৃহস্থালি তৈজসপত্রসহ হাজারো পণ্যের বিশ্বস্ত সূত্র মানে “জাদুর জিনি”। দৈনন্দিন জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে বিলাসবহুল পণ্য সবচেয়ে কম খরচে ঘরে বসে পেতে “জাদুর জিনি”র সঙ্গেই থাকুন।’
ফেসবুকে এভাবেই ২০২১ সাল থেকে লোভনীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছিল ‘জাদুর জিনি ডটকম’ নামক একটি ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছিলেন আশরাফুল ইসলাম ওরফে তারিকুল ইসলামসহ পাঁচ ব্যক্তি। পুলিশ এখন তাঁদের গ্রেপ্তারের জন্য খুঁজছে। তবে তাঁদের প্রলোভনে পা দিয়ে ইতিমধ্যে সর্বস্ব খুইয়েছেন সমাজের নানা স্তরের ব্যক্তি। মোটরসাইকেল কিনতে অগ্রিম টাকা দিয়েও তা পাননি ভুক্তভোগী ২৩ ব্যক্তি। তাঁদের একটি তালিকা গতকাল রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জাদুর জিনির তিনটি ঠিকানা রয়েছে। একটি হচ্ছে আউয়াল সেন্টার, ৩৪ কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ, বনানী, ঢাকা। অন্য দুটি হচ্ছে বাড়ি ১৫৪, রোড-৪ এবং বাড়ি-৩০, ব্লক-বি, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা। তিনটি ঠিকানাই এখন তালাবদ্ধ। শুরুর দিকে ৩০ শতাংশ ছাড়ে মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজ বিক্রির প্রচারণা চালিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়ের প্রলোভনে অনেকে পণ্য কিনতে টাকা দেয় প্রতিষ্ঠানটিকে। এ রকম ২৩ ব্যক্তির মোট ৩৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা নিয়ে জাদুর জিনির মালিকপক্ষ এখন পলাতক। তবে ফেসবুকে এখনো প্রতারণামূলক প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান মো. হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জাদুর জিনির ফেসবুক পেজটি বন্ধ করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি পাঠাব। এ ছাড়া জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ পুলিশকে আলাদা করে চিঠি পাঠাব কালই (আজ সোমবার)। ক্রেতারা যাতে এ ধরনের প্রতারণার ফাঁদে পা না দেন, এ জন্যও আহ্বান জানাই।’

মোটরসাইকেল কেনার আদেশ দিয়ে মোটরসাইকেল পাচ্ছেন না, টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না—এমন ভুক্তভোগী মো. তরিকুল ইসলাম গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে তিনি পাবেন ২ লাখ ৯০ হাজার ৭২০ টাকা। টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ মালিক পালিয়ে গেছেন। তাঁদের খুঁজে না পেয়ে তাঁদের নামে তিনি আদালতে মামলা করেছেন।

প্রতিষ্ঠানটির কাছে এ এফ এম শাফায়েত উল্লাহ শাহ নামের আরেক গ্রাহকের পাওনা ২ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ টাকা। তিনিও এ টাকা উদ্ধারে গত ৩০ জানুয়ারি আদালতে মামলা করেছেন। আদালত মামলা আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দেয়। পিবিআই গত ৭ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে এবং ১৩ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।

আশরাফুল ইসলাম ওরফে তারিকুল ইসলামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের মালিয়াটি গ্রামে। তাঁর তিনটি মোবাইল নম্বর ও তিনটি বিকাশ নম্বর। দুটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে আল–আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক ও ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংকে। দুটিই বসুন্ধরা শাখায়। আশরাফুল ইসলামের একাধিক নম্বরে ফোন দিয়ে গতকাল সব কটিই বন্ধ পাওয়া গেছে।

সরকারের একটি সংস্থা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, জাদুর জিনি ফেসবুক পেজে লোভনীয় প্রচার অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন গ্রাহক প্রতারণার শিকার হবেন এবং ভুক্তভোগীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়বে। প্রতারণা ও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধি রোধে জাদুর জিনির প্রচারণা বন্ধ করা দরকার। পাশাপাশি আসামিদের আদালতে সোপর্দ করা দরকার।

Jadur Jini ফেসবুক পেজে সর্বশেষ পোস্ট দেওয়া হয় ১২ অক্টোবর। ওই পোস্টে বলা হয়, ‘সারা দিন কাজ করে দিন শেষে পেট পূর্তির রসদ রান্নায় প্রয়োজন পুষ্টিকর তেল। পুষ্টি ও ফ্রেশের প্রতি ফোঁটার যত্নে খাবারের স্বাদ বাড়ান মনের মত করে। অর্ডার করুন এখনই। পুরো অর্থ পরিশোধে সারা দেশে হোম ডেলিভারি ৪৮ ঘণ্টায়। সর্বনিম্ন অর্ডার ১০ লিটার।’

এ ছাড়া চাল, সয়াবিন তেল, ডাল, ডিম, মসলা, ময়দা, পেঁয়াজ, রসুন, আলু, শর্ষে, চিনি, দুধ, লবণ ইত্যাদি পণ্যের চারটি আলাদা ধরনের প্যাকেজ রয়েছে জাদুর জিনির। বিকাশে অগ্রিম ক্রয়াদেশ দিলে ৭২ ঘণ্টায় হোম ডেলিভারি বলে প্রচারণা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এক হাজার থেকে চার হাজার টাকার এসব প্যাকেজে ৫০ শতাংশ খরচ কম বলেও বলা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট হচ্ছে jadurjini.com।

মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেলে ৩০ শতাংশ, নিত্যপণ্যে সাপ্তাহিক বাজারের কম্বো অফারে ৪১ শতাংশ, সয়াবিন তেলে ৩০ শতাংশ ছাড়ে পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটি হোটেল সেবা, বিমানের টিকিট বুকিং সেবা, মেডিকেল, বাস টিকিট ইত্যাদি সেবা নিয়ে শিগগির আসছে বলেও ফেসবুক এবং ওয়েবসাইটে প্রচার চালাচ্ছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ই–কমার্সবিষয়ক গবেষক সুবর্ণ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের প্রতারণা রোধে সরকারের নজরদারি দরকার। আবার এদের হাত থেকে বাঁচতে হলে গ্রাহকদেরও সতর্ক থাকা জরুরি।’