ট্যানারিমালিকদের বিরোধিতা
প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানি বন্ধ
গত অর্থবছরে ১০০ কোটি ডলারের সমান রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, এখনো ৩০০ কোটি টাকার সমমূল্যের রপ্তানির ক্রয়াদেশ রয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে ওয়েট ব্লু বা প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানির অনুমতি রয়েছে সরকারের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা প্রধান আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত নতুন করে ৭টি প্রতিষ্ঠানকে এ অনুমতি দিয়ে রেখেছে। আগেরবার দেওয়া হয়েছিল পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে। বছরে প্রায় দুই কোটি বর্গফুট রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে ব্যবসায়ীরা রপ্তানি করেও আসছিলেন।
কিন্তু দুই মাস ধরে হঠাৎ করে এ রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) বিরোধিতার কারণেই রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। বেশির ভাগ রপ্তানিকারক এ সমিতির সদস্য। আর কিছু রপ্তানিকারক বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সদস্য। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানি করতে হলে কমপক্ষে একটি সমিতির সনদ থাকা বাধ্যতামূলক।
পশুর শরীর থেকে সংগৃহীত চামড়া পশম ছাড়িয়ে প্রক্রিয়াজাত করার পর যে চামড়া পাওয়া যায়, সেটিকে প্রক্রিয়াজাত বা ওয়েট ব্লু চামড়া বলা হয়। ১৯৯০ সালের আগপর্যন্ত এ ধরনের চামড়া বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হতো। ৩০ বছর পর ২০২১ সালের জুলাইয়ে আবার রপ্তানি অনুমতি দেওয়া হয়।
যোগাযোগ করা হলে বিটিএর সভাপতি শাহীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির বিরোধী। এটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। গুটিকয় প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে পুরো চামড়া খাতের বিনিয়োগকে আমরা ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারি না।’
বাংলাদেশ থেকে সব সময় চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, জাপান ও স্পেনের মতো দেশে ‘ক্রাস্ট’ ও ‘ফিনিশড লেদার’ রপ্তানি হয়ে আসছে। ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার পর নতুন করে উজ্জীবিত হয় চামড়া ও চামড়াজাত খাত। তাতে এ খাতের রপ্তানি গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানির শর্ত হিসেবে বলা হয়, রপ্তানিনীতি অনুসরণ করে মানসম্মত প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানি করতে হবে। জাহাজীকরণ শেষে রপ্তানিসংশ্লিষ্ট সব কাগজ দাখিল করার পাশাপাশি যে দেশে রপ্তানির জন্য অনুমতি দেওয়া হবে, সে দেশেই এ চামড়া রপ্তানি করতে হবে।
জানা গেছে, প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করে লেদার বায়িং এজেন্টস কো-অপারেটিভ সোসাইটি। রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রপ্তানিকারকদের পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়েছে এ সমিতির সদস্যরাও। তাই গত মাসে লেদার বায়িং এজেন্টস কো-অপারেটিভ সোসাইটি এক জরুরি সভা করে। ওই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিটিএ সভাপতি শাহীন আহমেদ। এ সময়ও শাহীন আহমেদ প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানির বিরোধিতা করেন।
এদিকে বিএফএলএলএফইএ সভাপতি মাহিন আহমেদও গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানির আবেদন এলে আমরা সনদ দিই। তবে এক বর্গফুট প্রক্রিয়াজাত চামড়া উৎপাদনে যেখানে এক ডলার খরচ পড়ছে, সেখানে ৬০ সেন্টে তা রপ্তানি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ কোটি ৩০ লাখ বর্গফুট প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ডলারে। রপ্তানিকারকেরা জানান, এই মুহূর্তে ৩০০ কোটি টাকার সমমূল্যের ক্রয়াদেশ রয়েছে। কিন্তু রপ্তানির সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করছে বিটিএ। বর্তমানে ৬০ থেকে ৭০ লাখ পিস প্রক্রিয়াজাত চামড়া মজুত রয়েছে।
রপ্তানি বন্ধের বিষয়টি নিয়ে গতকাল চারজন প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানিকারকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তবে তাঁদের কেউই নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঈদুল আজহায় পশুর কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে ২০২০ সালেই বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানির সুপারিশ করেছিল। রপ্তানি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ওই সুপারিশই আমলে নেয় মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে পবিত্র ঈদুল আজহার পর সরকার পশুর চামড়া নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ে। দাম না পেয়ে অনেকে মাটিতে চামড়া পুঁতে ফেলেছিলেন। তাই রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে ঈদুল আজহায় ১ কোটি ২০ লাখের মতো পশু জবাই হয়। এগুলোর মধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ লাখ গরু-মহিষ। ঈদুল আজহায় জবাই হওয়া গরুর স্বাস্থ্য ভালো থাকে বলে চামড়ার মানও খুব ভালো হয়। তাই ট্যানারিগুলো মোট চামড়ার ৫০ শতাংশই সংগ্রহ করে ঈদুল আজহায়।
প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানিকারকেরা বলছেন, দাম না পেয়ে দু-তিন বছর আগে যে কাঁচা চামড়া পুঁতে ফেলতে হয়েছিল, রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলে আবার সেই পরিস্থিতি তৈরি হবে।
সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে এ বিষয়ে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি অনুমতি বহাল আছে। আর সমিতির সনদ যে লাগেই তা আমার জানার বাইরে। কোনো অভিযোগ এলে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।’