দুই বছরের মুদ্রণশিল্প নগরী প্রকল্পে ১০ বছর গেল জমি পেতেই, তবু শঙ্কা

বিসিক

১০ বছর আগে শুরু হয়েছিল দেশের একমাত্র মুদ্রণশিল্প নগরী প্রকল্প। এর মধ্যে মেয়াদ বেড়েছে দুই দফা, বেড়েছে ব্যয়ও। সেই বর্ধিত মেয়াদের বাকি আর দেড় বছর। কিন্তু ভূমি উন্নয়নকাজই এখনো শেষ হয়নি। ফলে ১০ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি এই শিল্পনগরী। ফলে ১০ বছর পর এসেও এই মুদ্রণশিল্প নগরী কবে চালু হবে, সেটি এখনো অনিশ্চিত।

জানা যায়, দেশের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুদ্রণশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে ২০১৬ সালে এ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক)। এ জন্য মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বড়বত্তা এলাকায় ৪৩ একর জায়গায় এই শিল্পনগরী স্থাপনের অনুমোদন দেয় তৎকালীন সরকার। সে সময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩৮ কোটি টাকা। আর প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে ভূমি অধিগ্রহণ, জনবসতি উচ্ছেদসহ নানা জটিলতায় শুরুতেই ধাক্কা খায় প্রকল্পটি। প্রকল্প শুরুর ছয় বছর পর ২০২২ সালে এসে প্রকল্পের স্থান পরিবর্তন করে বিসিক। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের বড়বত্তা থেকে এটিকে সরিয়ে নেওয়া হয় খারসুর এলাকায়। সেখানে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৪০০ একর জমির জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে বিসিক। তবে শিল্প মন্ত্রণালয় প্রকল্পের জন্য ১০০ একর জমি বরাদ্দ দেয়। স্থান পরিবর্তনের কারণে বাড়ানো হয় প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয়। ১৩৮ কোটি টাকা থেকে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৭৫ কোটি টাকা। আর মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০২৪ সাল পর্যন্ত। তারপরও প্রকল্পটির কাজ শুরু করতে পারেনি বিসিক। তাই আরেক দফা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত করা হয়।

বিসিকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে শিল্পনগরীর জন্য বরাদ্দ করা জমি আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝে পেয়েছে সংস্থাটি। জমি বুঝে পাওয়ার পর নামজারির কাজটিও সম্পন্ন হয়েছে। অবশ্য তত দিনে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ৪৪৮ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দফায় দফায় ব্যয় বৃদ্ধির পরও নির্ধারিত সময়ে এই শিল্পনগরীর কাজ শেষ না হওয়ায় এ প্রকল্পের কোনো সুবিধায় পাচ্ছেন না এই খাতের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।

এ ধরনের প্রকল্পের বড় চ্যালেঞ্জ ভূমি অধিগ্রহণ। ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতার কারণে এ প্রকল্পের স্থান ও মেয়াদও দুই দফায় পরিবর্তন হয়েছে। প্রকল্পটি যখন হাতে নেওয়া হয়, তখন এটির সম্ভাবনা পরীক্ষা বা ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়নি
মো. সাইফুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, বিসিক

জানতে চাইলে বিসিকের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের প্রকল্পের বড় চ্যালেঞ্জ ভূমি অধিগ্রহণ। ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতার কারণে এ প্রকল্পের স্থান ও মেয়াদও দুই দফায় পরিবর্তন হয়েছে। প্রকল্পটি যখন হাতে নেওয়া হয় তখন এটির সম্ভাবনা পরীক্ষা বা ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়নি। তবে ব্যয় বাড়ার বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে শিল্প মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। তাই ব্যয় বেড়ে যাওয়া থেকেও কাজ সময়মতো শেষ করাটাই এখন আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

এদিকে প্রকল্পের কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই না হওয়ায় এটির ভবিষ্যৎ সফলতা নিয়েও সংশ্লিষ্টদের মনে রয়েছে শঙ্কা। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না মিললে যাদের জন্য এ প্রকল্প তারা সেখানে শিল্প স্থাপন করবেন কি না, এটা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। তারপরও খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চান, দ্রুত প্রকল্পটি শেষ হোক। তাহলে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা নতুন করে এ প্রকল্পে কারখানা বা শিল্প স্থানান্তরের চিন্তাভাবনা শুরু করতে পারবেন।

বিসিকের সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে মুদ্রণশিল্প নগরীর সীমানাপ্রাচীর, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থাসহ শিল্পনগরীর সামগ্রিক নকশার কাজ দেওয়া হয় গ্লোবাল ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যানার্স অ্যান্ড কনসালট্যান্ট জেভি নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। তবে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও নকশা তৈরির ক্ষেত্রে সক্ষমতার অভাব রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। ফলে প্রকল্পের নকশা বাস্তবায়নের অগ্রগতি ধীরগতিতে এগোচ্ছে।

অনেক বছর ধরেই এ প্রকল্পের কাজ চলছে। এই খাতের ব্যবসায়ীরা প্রকল্প শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। আমরাও প্লট বরাদ্দের টাকা নিয়ে প্রস্তুত রয়েছি। আমাদের ব্যবসায়ীরাও তাঁদের ব্যবসা এই শিল্প নগরীতে নিয়ে যেতে আগ্রহী
জুনায়েদুল্লাহ আল মাহফুজ, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, মুদ্রণশিল্প সমিতি

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. রাকিবুল হাসান বলেন, প্রকল্পটি শুরু থেকে নানা বাধা পেরিয়ে এ পর্যন্ত এসেছে। তবে ভূমি অধিগ্রহণের মতো বড় কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। এখন ভূমির উন্নয়নে মাটি ভরাট চলছে। তবে যে প্রতিষ্ঠান এই নগরীর নকশা করছে, তাদের সক্ষমতার কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। আশা করছি, এই জটিলতা দ্রুত দূর হয়ে যাবে। আর নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে এই কাজ শেষ হয়ে যাবে।

দেশে মুদ্রণশিল্প নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির দাবি, দেশে সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার মুদ্রণশিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৬ হাজারের বেশি। সব মিলিয়ে বছরে এ শিল্পে ব্যবসা হয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে সার্বিকভাবে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মুদ্রণশিল্প কারখানা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি জুনায়েদুল্লাহ আল মাহফুজ বলেন, ‘অনেক বছর ধরেই এ প্রকল্পের কাজ চলছে। এ খাতের ব্যবসায়ীরা প্রকল্প শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। আমরাও প্লট বরাদ্দের টাকা নিয়ে প্রস্তুত রয়েছি। আমাদের ব্যবসায়ীরাও তাঁদের ব্যবসা এই শিল্পনগরীতে নিয়ে যেতে আগ্রহী। এই শিল্পনগরী হলে আমাদের মুদ্রণকাজের জন্য আর বিদেশ যেতে হবে না।’