দেশে ব্যবসার পরিবেশে অবনতি 

১১টি সূচকের মধ্যে ৭টির মানের অবনতি হয়েছে। তিনটি সূচক সামান্য উন্নতির দিকে। গতকাল এ সূচক প্রকাশ করা হয়। 

বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ গত এক বছরে কোনো উন্নতি হয়নি, উল্টো অবনতি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে ২০২৩ সালে দেশের ব্যবসার পরিবেশের সূচকের ১০০ স্কোরের মধ্যে অর্জন ৫৮ দশমিক ৭৫। যা ২০২২ সালে ছিল ৬১ দশমিক ৯৫। 

ব্যবসা পরিবেশ সূচক বা বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ২০২৩-২৪ জরিপে এমন চিত্রই উঠে এসেছে। জরিপের তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ পাওয়া আরও কঠিন হয়েছে। কর ও ভ্যাট পরিশোধে হয়রানি রয়ে গেছে। ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া আরও বেশি জটিল হয়েছে। এ ছাড়া আইনকানুনের তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামো সুবিধা, শ্রম নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসায় বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। 

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ তৃতীয়বারের মতো বিবিএক্স জরিপ পরিচালনা করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে এমসিসিআইয়ের কার্যালয়ে জরিপের ফল প্রকাশ হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। স্বাগত বক্তব্য দেন এমসিসিআইয়ের সভাপতি কামরান টি রহমান। মূল প্রতিবেদন পাঠ করেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ। 

এমসিসিআইয়ের সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, দেশের সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা পেতে এই জরিপ করা হয়েছে। কোন খাতে কেমন নীতি গ্রহণ করা দরকার, সে বিষয়ে ধারণা দেবে বিবিএক্স। এর ফলে নীতিপ্রণেতাদের সঙ্গে বিনিয়োগকারীরাও বুঝতে পারবেন, তাঁদের কোন পথে চলতে হবে। 

ব্যবসা শুরু, জমির প্রাপ্যতা, আইনকানুনের তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামো সুবিধা, শ্রমনীতি, বিরোধ নিষ্পত্তি, বাণিজ্যসুবিধা, কর পরিশোধ, প্রযুক্তির ব্যবহার, ঋণের প্রাপ্যতা এবং পরিবেশগত নিয়মনীতি ও মান—এই ১১টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে জরিপটি করা হয়েছে। সর্বশেষ সূচকটি এবারই প্রথম যুক্ত হয়েছে। দেশের আটটি বিভাগের সেবা, উৎপাদন ও কৃষি খাতের ৫২০ জন ব্যবসায়ীর ওপর বিবিএক্স জরিপটি পরিচালনা করা হয়। তাদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ কুটির ও ক্ষুদ্র, ১৬ শতাংশ মাঝারি ও ১৮ শতাংশ বৃহৎ শিল্পের উদ্যোক্তা। 

ব্যবসার পরিবেশ সহজ করতে এখনো বড় চ্যালেঞ্জ এনবিআর। বারবার বলা হচ্ছে, করজালের আওতা বাড়িয়ে করহার কমিয়ে দিলে রাজস্ব আহরণ বাড়বে। তবে তারা প্রতিবার যারা কর দিচ্ছে, তাদের আরও বেশি চাপে ফেলছে।
সালমান এফ রহমান, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা

জরিপের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে সামগ্রিকভাবে ব্যবসার পরিবেশ সূচকের ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছিল ৬১ দশমিক শূন্য ১। পরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে সেটি সামান্য বেড়ে ৬১ দশমিক ৯৫ হয়। ২০২৩ সালে প্রাপ্ত নম্বর ৫৮ দশমিক ৭৫। সূচকের মানে অবনমনের কারণ, ১১টি সূচকের মধ্যে ৭টিতেই অবনতি হয়েছে। তিনটি সূচক সামান্য উন্নতির দিকে। 

মাসরুর রিয়াজ বলেন, যেসব কারণে সূচকগুলোতে অবনতি হয়েছে সেসব জায়গায় সংস্কার আনতে হবে। অন্যথায় ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি হবে না। 

জরিপের তথ্যানুযায়ী, ১১টি সূচকের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে খারাপ করেছে ঋণের প্রাপ্যতা সূচকে। এই সূচকে প্রাপ্ত নম্বর মাত্র ২৮ দশমিক ১১। জরিপে অংশ নেওয়া ৯০ শতাংশ ব্যবসায়ী জানান, দুই বছর ধরে ব্যাংকঋণ ও অর্থায়ন পেতে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। কোনো সূচকের স্কোর যদি ০ থেকে ৪০-এর মধ্যে থাকে, তার মানে হলো দেশে ব্যবসার পরিবেশ খুবই কঠিন। 

কোনো সূচকের প্রাপ্ত নম্বর ৪১ থেকে ৬০-এর মধ্যে থাকা মানে সেখানে ব্যবসায় বেশ কিছু বাধা রয়েছে। এ স্কোরের মধ্যে আছে দুটি সূচক। তার মধ্যে পরিবেশগত নিয়মনীতি ও মান সূচকে প্রাপ্ত নম্বর ৫১ দশমিক ৫৯। এ ছাড়া কর পরিশোধ সূচকের নম্বর ৫৪ দশমিক ৭৪। ২০২২ সালে এই সূচকে প্রাপ্ত নম্বর বা স্কোর ছিল ৫৫ দশমিক ২১। জরিপে অংশ নেওয়া ৮৫ শতাংশ ব্যবসায়ী জানান, ভ্যাট ও আয়কর নিবন্ধন সহজ হয়েছে। তবে এ জন্য অতিরিক্ত অর্থ দিতে হচ্ছে। ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যবসায়ী আয়কর ও ভ্যাট পরিশোধে হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানান। তারপরের অবস্থানে আছে জমির প্রাপ্যতা সূচক, স্কোর ৫৩ দশমিক শূন্য ১১। তার আগের বছর এই সূচকের স্কোর ছিল ৫৩ দশমিক ০৭। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৫ শতাংশ ব্যবসায়ী জানান, জমি ক্রয়-বিক্রয়ে অনৈতিক অর্থের লেনদেন বেশি। নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় সরকারি সংস্থার হয়রানিও রয়েছে। 

এ ছাড়া কোনো সূচকের স্কোর ৬১ থেকে ৮০-এর মধ্যে থাকা মানে দেশে ব্যবসার পরিবেশ উন্নতির দিকে। এ স্কোরের মধ্যে আছে সাতটি সূচক। তার মধ্যে ৬০ দশমিক ৮৭ স্কোর নিয়ে তলানিতে আছে বাণিজ্যসুবিধা। ২০২২ সালে এই সূচকের স্কোর ছিল ৫৮ দশমিক ৬১। তার মানে বাণিজ্য সুবিধা সূচকের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহার সূচকে স্কোর ৬৩ দশমিক ৫০, বিরোধ নিষ্পত্তিতে ৬২ দশমিক ৩৮, ব্যবসা শুরুর সূচকে ৬২ দশমিক ৭৪, আইনকানুনের তথ্যপ্রাপ্তি সূচকে ৬৮ দশমিক ০৪, শ্রমনীতি সূচকে ৭০ দশমিক ০৪ এবং অবকাঠামো সূচকে ৭১ দশমিক ০৮ স্কোর। অন্যদিকে ৮১ থেকে ১০০ স্কোর থাকলে বলা হয়, পরিবেশ ব্যবসাবান্ধব। এ স্কোরে কোনো সূচক আপাতত নেই। 

জরিপে দেখা গেছে, ১১টি সূচকে খাত ভেদে ব্যবসায়ীদের সমস্যাও ভিন্ন। ব্যবসা শুরু করা ইলেকট্রনিক ও হালকা প্রকৌশল খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য তুলনামূলক সহজ হলেও ওষুধ ও রাসায়নিক পণ্যের ব্যবসা কঠিন। আবার ব্যবসার পরিবেশের স্কোরে রাজশাহী বিভাগ এগিয়ে। বরিশাল সবচেয়ে পিছিয়ে। এ ক্ষেত্রে রাজশাহীর স্কোর ৬১ দশমিক ৪৮ আর বরিশালের স্কোর ৫৪ দশমিক ৭৩। 

অনুষ্ঠানে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনতে বিশ্বাসযোগ্যতা, ধারাবাহিকতা ও সক্ষমতা দরকার। বাংলাদেশে নতুন কোম্পানির ব্যবসা শুরু করতে ২৩টি দপ্তরের ১৫০টি অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের করব্যবস্থা খুবই জটিল। এসব সহজ করতে হবে। 

রাজস্ব আয় বাড়াতে করহার কমানো উচিত বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ব্যবসার পরিবেশ সহজ করতে এখনো বড় চ্যালেঞ্জ এনবিআর। বারবার বলা হচ্ছে, করজালের আওতা বাড়িয়ে করহার কমিয়ে দিলে রাজস্ব আহরণ বাড়বে। তবে তারা প্রতিবার যারা কর দিচ্ছে, তাদের আরও বেশি চাপে ফেলছে। আসলে সবাইকে করের আওতায় আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, কীভাবে ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি করা যায় তা বিডাকে (বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) খুঁজে বের করতে হবে। বিবিএক্স প্রতিবেদন পর্যালোচনা করতে বিডাকে পরামর্শও দেন তিনি। 

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া, এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির, জেট্রোর এ–দেশীয় প্রধান ইউজি আন্দো। আরও উপস্থিত ছিলেন এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি তপন চৌধুরী।