তৈরি পোশাক রপ্তানি
ভারত-শ্রীলঙ্কার চেয়েও কম দাম এ দেশের পোশাকের
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এখনো বৈচিত্র্য তুলনামূলক কম। এখনো মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশই ৫টি খাত থেকে আসছে।
কম দামের তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে বেরোতে পারছে না বাংলাদেশ। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শুধু ভিয়েতনাম নয় ভারত, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মরক্কোর মতো প্রতিযোগী দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি দামে তৈরি পোশাক রপ্তানি করছে। কম দামের পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের চেয়ে ওপরে আছে শুধু চীন ও পাকিস্তান।
সারা বিশ্বের তৈরি পোশাকের বড় আমদানিকারক যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে গত বছর এই চিত্র দেখা গেছে। যদিও বিশ্বে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক। গত বছর সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ২০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে চীন। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ করেছে ৪ হাজার ৫৭১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি।
ইইউর পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাট এবং যুক্তরাষ্ট্রের বস্ত্র ও পোশাকসংক্রান্ত বিভাগ অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে ইইউর বাজারে রপ্তানি হওয়া প্রতি কেজি পোশাকের গড় মূল্য ছিল ২২ দশমিক ৪৮ ডলার। সেখানে বাংলাদেশ প্রতি কেজি পোশাক রপ্তানি করেছে ১৭ দশমিক ২৭ ডলারে। প্রতিযোগী দেশ ভারত প্রতি কেজি পোশাক রপ্তানি করেছে ২৩ দশমিক ২৭ ডলারে। আর শ্রীলঙ্কার রপ্তানি করা প্রতি কেজি পোশাকের দাম ২৮ দশমিক ৫৪ ডলার। এই বাজারে বাংলাদেশের চেয়ে কম দামে পোশাক রপ্তানি করেছে পাকিস্তান, ১৪ দশমিক ৪৭ ডলারে।
অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত বছর রপ্তানি হওয়া প্রতি বর্গমিটার কাপড়ের সমপরিমাণ পোশাকের গড় মূল্য ছিল ৩ দশমিক ২১ ডলার। বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে তার চেয়েও কম দামে, অর্থাৎ ৩ দশমিক ১০ ডলারে। আর প্রতি বর্গমিটার কাপড়ের সমপরিমাণ পোশাক ভারত ও শ্রীলঙ্কা রপ্তানি করেছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৮০ ও ৪ দশমিক ২৬ ডলারে। এই বাজারে বাংলাদেশের চেয়ে কম দামে পোশাক রপ্তানি করেছে চীন, ২ দশমিক শূন্য ২ ডলারে। আর পাকিস্তান করেছে ৩ দশমিক শূন্য ৩ ডলারে।
বড় দুই বাজারে অধিকাংশ প্রতিযোগী দেশের তুলনায় কম দামে পোশাক রপ্তানি করা ভালো নাকি মন্দ—এমন প্রশ্নের জবাবে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবশ্যই এটি আমাদের জন্য খারাপ। ভয়াবহ খারাপ বললেও ভুল হবে না। মূলত দর–কষাকষির দুর্বলতার কারণেই আমাদের তৈরি পোশাকের দাম অন্য দেশগুলোর চেয়ে কম। ইইউর বাজারে পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাই আমরা। তার মানে যেসব রপ্তানিকারক দেশ শুল্কসুবিধা পায় না, তাদের চেয়ে আমাদের পোশাকের দাম বেশি পাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা ইইউতে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ কম দাম পাচ্ছি।’
ফজলুল হক আরও বলেন, ‘আমরা যে পোশাক ১০ ডলারে বিক্রি করি, সেই একই পোশাক ভারত ১২ ডলারে বিক্রি করে। মূলত দর–কষাকষির দক্ষতার কারণেই ভারত ভালো দাম পাচ্ছে। ভবিষ্যতে পোশাকশ্রমিকের মজুরির পাশাপাশি অন্যান্য খরচও বাড়বে। তখন ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে আমাদের উদ্যোক্তাদের দর-কষাকষির দক্ষতা বাড়াতে হবে।’
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এখনো বৈচিত্র্য তুলনামূলক কম। পোশাকের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশই ৫টি খাত থেকে আসছে। গত জুনে শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। তার মধ্যে মোটাদাগে পাঁচ ধরনের পোশাকের রপ্তানি ৩ হাজার ৭৭৫ কোটি ডলার। সেগুলো হচ্ছে ১ হাজার ৪৯৫ কোটি ডলারের ট্রাউজার, ১ হাজার ৮৬ কোটি ডলারের টি-শার্ট ও নিটেড শার্টস, ৫৯৪ কোটি ডলারের সোয়েটার, ৩৬৫ কোটি ডলারের শার্ট ও ব্লাউজ এবং ২৩৭ কোটি ডলারের অন্তর্বাস।
অবশ্য পোশাক খাতের সব কারখানা যে কম দামের পোশাক রপ্তানি করে, তা নয়। অনেক কারখানাই বর্তমানে ব্লেজার, জিনস প্যান্ট, জ্যাকেট, এমনকি টি-শার্ট অনেক বেশি দামে রপ্তানি করছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্নোটেক্স গ্রুপ। এই শিল্পগোষ্ঠী একেকটি জ্যাকেট ১০ ডলার থেকে শুরু করে ৫০ ডলারে রপ্তানি করছে।
এ বিষয়ে স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশি দামের পোশাক তৈরির পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে আমাদের কারখানাগুলো বিনিয়োগ করছে। আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে সেটি হয়ে যাবে। তখন বেশি দামে পোশাক রপ্তানি বাড়বে। বর্তমানে আমরা তৈরি পোশাক রপ্তানির সংযোগ শিল্পে পিছিয়ে আছি। এ ছাড়া আমাদের গভীর সমুদ্রবন্দর নেই। সরাসরি বড় জাহাজ চট্টগ্রামে আসতে পারে না। এসব কারণে ভিয়েতনাম ও চীনের চেয়ে পোশাক রপ্তানিতে আমাদের বেশি সময় লাগে। তাই আমাদের উদ্যোক্তাদের বাধ্য হয়ে ক্রেতাদের কিছুটা কম দাম অফার করতে হয়।’
ইউরোস্ট্যাটের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ গত বছর ১৩২ কোটি কেজি পোশাক রপ্তানি করেছে ইইউতে। তাতে পোশাকের প্রতি কেজির গড় দাম পড়েছে ১৭ ডলার ২৭ সেন্ট। ২০২১ সালে প্রতি কেজি পোশাকের রপ্তানি মূল্য ছিল ১৫ ডলার ৪২ সেন্ট। এই বাজারে পোশাকের রপ্তানি মূল্য ১১ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি হওয়া পোশাকের দামও প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়েছে। তথ্যটি ইতিবাচক হলেও পোশাকের মূল্যে বাংলাদেশ এখনো তলানিতে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পোশাক রপ্তানির ঝুলিতে সস্তা পণ্যই বেশি। অন্যদিকে চীন, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার পোশাক রপ্তানির ঝুলিতে বেশি দামে পণ্য বেশি। আমাদের দেশের কারখানাগুলোর বাজার বিশ্লেষণ না করে নিজেরাই উৎপাদন সক্ষমতা অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়েছে। এসব কারখানার বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ধরে রাখতে নিয়মিত ক্রয়াদেশ দরকার। বিদেশি ক্রেতারা এই দুর্বলতা জানেন বলেই দর-কষাকষিতে এগিয়ে থাকেন।’