রপ্তানির আট গুণ পণ্য আমদানি

নয়াদিল্লিতে গতকাল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সিইপিএ) সইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন।

প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ছে। ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি যেমন বাড়ছে, তেমনি দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আমদানি-রপ্তানির পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যঘাটতি এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি।

গত ১০ বছরে ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বেড়ে প্রায় ৪ গুণ হয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে ভারতে ৪৯ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ, যা সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৯ কোটি ডলার।

একইভাবে ২০১১-১২ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছিল ৪৭৪ কোটি ডলারের পণ্য। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৬১৯ কোটি ডলার। সেই হিসাবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশ এখন ১ হাজার ৪২০ কোটি ডলারের ঘাটতির মুখে। প্রতি ডলার ৯৫ টাকা দরে হিসাব করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় ঘাটতি দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশ রপ্তানির আট গুণের বেশি পণ্য আমদানি করে।

বেশি মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে ভারতীয় বিনিয়োগে। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, প্রবৃদ্ধিতেও সহায়তা হবে। ভারতীয় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে দেশটির জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এতে সাফল্যের হার খুবই কম।
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

বাংলাদেশ ব্যাংক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন থেকে নেওয়া তথ্যে দুই দেশের আমদানি-রপ্তানির এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

ভারতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলো হচ্ছে তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, মাছ, কোমলপানীয়, তামা, ভোজ্যতেল ইত্যাদি। আর ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা প্রধান পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে চাল, কাঁচা তুলা, পেঁয়াজ, মোটরগাড়ি, বয়লার, ইলেকট্রনিক পণ্য, লোহা, যন্ত্রপাতি, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার ইত্যাদি।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গত সোমবার দিল্লি গেছেন। পরদিন মঙ্গলবার তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। এতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সিইপিএ) সইয়ের কথা উঠে এসেছে।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসইপিএ সইয়ের ঘোষণা দেন। এ সময় নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে আমরা বাণিজ্য বাড়াতে আগ্রহী। সে জন্য এসইপিএ সই করার কার্যক্রম শুরু করব।’

উভয় দেশের বাণিজ্যচিত্র

ভারত ২০১১ সালে বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়। এর পর থেকেই দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়তে থাকে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এক রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসার পর থেকে এই শুল্কসুবিধা কার্যকর হয়।

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভারতে ৮৭ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এর পর থেকে প্রতিবারই রপ্তানি আয় শতকোটি ডলারের ওপরে রয়েছে। তবে কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতে রপ্তানি হয় ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য।

অন্যদিকে ভারত থেকে আমদানি ব্যাপকহারে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশটি থেকে আমদানি হয়েছিল ৮৬২ কোটি ডলারের পণ্য। মাঝখানে একটু কমলেও সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি, অর্থাৎ ১ হাজার ৬১৬ কোটি ডলারে ওঠে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশের কাছে ভারত একটি বড় বাজার। দেশটি থেকে পণ্য আনতে সময় ও খরচ কম লাগে, আবার দেশটিতে পণ্য পাঠাতেও একই সুবিধা পাওয়া যায়। এসইপিএ বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) হলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়বে। এতে উভয় দেশের জনগণ উপকৃত হবেন।

বাণিজ্য বৃদ্ধিতে আপাতত স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি বলে মনে করেন শহীদুল্লাহ আজিম।

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশের কাছে ভারত একটি বড় বাজার। দেশটি থেকে পণ্য আনতে সময় ও খরচ কম লাগে, আবার দেশটিতে পণ্য পাঠাতেও একই সুবিধা পাওয়া যায়। এসইপিএ বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) হলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়বে।
শহীদুল্লাহ আজিম, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, বিজিএমইএ

বাণিজ্য ব্যবধান কি কমবে

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বরাবরই ভারতের পক্ষে। গত অর্থবছরে তা হঠাৎ অনেক বড় হয়ে যায়। এর মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের নানামুখী চ্যালেঞ্জে পড়ার কথা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের দিক থেকে ভারতকে সিইপিএ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

গত বছর বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘সমৃদ্ধির জন্য আন্তযোগাযোগ: দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাঞ্চলের সমন্বিত পরিবহনব্যবস্থা চালুর চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের মোট ব্যবসা-বাণিজ্যের ১০ শতাংশ হয় ভারতের সঙ্গে, আর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য হয় মাত্র ১ শতাংশ।

তবে এফটিএ হলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ১৮২ শতাংশ, অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ১২৬ শতাংশ বাড়বে। আর নিরবচ্ছিন্ন পরিবহনব্যবস্থা চালু হলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ২৯৭ শতাংশ ও বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ১৭২ শতাংশ বাড়বে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ভারত থেকে বেশি আমদানি মানেই যে খারাপ কিছু, তা নয়। আর রপ্তানি বৃদ্ধি দিয়ে বাণিজ্য ব্যবধান কমানো যাবে না। সিইপিএ হলে সুবিধা হবে ঠিক। এতে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি শুধু বাড়বে না, ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানিও বাড়বে। ভারত এতে আরও বেশি কর সুবিধা পাবে, এটাও মাথায় রাখতে হবে।

করণীয় হিসেবে সেলিম রায়হান বলেন, বেশি মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে ভারতীয় বিনিয়োগে। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, প্রবৃদ্ধিতেও সহায়তা হবে। ভারতীয় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে দেশটির জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এতে সাফল্যের হার খুবই কম।

দিল্লি সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ভারতীয় শিল্পপতি গৌতম আদানির বৈঠক হয়েছে, বিনিয়োগ আকর্ষণের দিক থেকে তা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন সেলিম রায়হান।