দিনে শতকোটি টাকার চা পান

প্রতিদিন লিকার ও দুধ চা হিসেবে কমবেশি ১০ কোটি কাপ চা পান করে বাংলাদেশের মানুষ। প্রতি কাপ চায়ের গড় দাম পড়ে ১০ টাকা। সেই হিসাবে এই বাণিজ্য শতকোটি টাকার। বাংলাদেশ চা বোর্ড, নিলাম পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলোর প্রতিবেদন ও চা ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যে এ হিসাব পাওয়া গেছে।

বাগানে উৎপাদনের পর কাপে চুমুক দেওয়া পর্যন্ত ধাপে ধাপে চায়ের মূল্য সংযোজিত হয়। এর মধ্যে বেশি মূল্য সংযোজন হয় চা-পাতা যখন পানীয় হিসেবে ভোক্তার কাপে ওঠে। কারণ, তখন চায়ের সঙ্গে দুধ, চিনির মতো নানা উপকরণ যুক্ত হয়। মূল্য সংযোজন হয়ে এভাবে এই পানীয় বেচাকেনার বাজার বড় হচ্ছে।

চায়ের বাজারে শীর্ষ পর্যায়ের একটি কোম্পানির জরিপ অনুযায়ী, দেশে চা পানের ৫০-৫৫ শতাংশ হয় হোটেল-রেস্তোরাঁ ও চায়ের স্টলে। বাসাবাড়ি ও অফিসে হয় ৪৫-৫০ শতাংশ। এ হিসাবে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও চায়ের স্টলে দিনে অন্তত অর্ধশত কোটি টাকার চা পানীয় হিসেবে বিক্রি হয়।

যেভাবে বাণিজ্য বাড়ছে

চা বোর্ডের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ মৌসুমে (এপ্রিল-মার্চ) নিলামে চা বিক্রি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার। এর বাইরে রয়েছে কর দিয়ে বাগান থেকে সংগ্রহ করা চা। সব মিলিয়ে গত মৌসুমে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার কাছাকাছি চা বিক্রি হয়েছে। নিলামে বিক্রি হয় মূলত দেশের ১৬৮টি বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চাষের মাধ্যমে উৎপাদিত চা।

চা উৎপাদনের এই বাণিজ্যে রয়েছে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান। দেশীয় ১৮টি শিল্প গ্রুপ ছাড়াও ব্যক্তিমালিকানাধীন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে চা উৎপাদনে। আবার স্টারলিং বা ইউরোপীয় কোম্পানি হিসেবে রয়েছে চারটি। দুই ক্যাটাগরিতে উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে ফিনলে, ডানকান, ন্যাশনাল টি, ইস্পাহানি, এম আহমেদ, সিটি গ্রুপ প্রভৃতি কোম্পানি।

চা-বাগানের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের সাবেক সভাপতি এম শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, সবুজ পাতা থেকে কারখানায় প্রক্রিয়াজাতের পর চা তৈরি হয়। এই চায়ে মূল্য সংযোজিত হয় মূলত বিপণন ও বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলোর হাত ধরে। প্যাকেটজাত ও ব্লেন্ডিংয়ের (নানা রকমের চা মিশিয়ে নতুন স্বাদের চা তৈরি হয়) মাধ্যমে মূলত মূল্য সংযোজিত হয়।

উৎপাদকের হাত ঘুরে এই চা আসে ব্যবসায়ীদের কাছে। নিলামে কেনা বা বাগানের মালিকেরা নিজেদের বাগানের চা বাজারজাত করার আগে সরকারকে কর দিতে হয়। এতে বছরে ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার কাছাকাছি সরকার রাজস্ব পায়। এই রাজস্ব মূলত নিলামে কেনা চায়ের দামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রথম দফায় মূল্য সংযোজিত হয়।

বড় কোম্পানিগুলো প্যাকেটজাত করে নানা ব্র্যান্ডের নামে চা বাজারজাত করে। এই বাজারজাতের সময় দ্বিতীয় দফায় মূল্য সংযোজন হয়। চা বোর্ড ও চা নিলামকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ মৌসুমে রপ্তানি বাদ দিয়ে বাজারজাতের জন্য কোম্পানিগুলো ৯ কোটি ১২ লাখ কেজি চা কিনেছে। সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ মোট চায়ের ২১ শতাংশের অংশীদার ইস্পাহানি টি লিমিটেড। কোম্পানিটি প্রায় ১ কোটি ৯২ লাখ কেজি চা বাজারজাতের জন্য কিনেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আবুল খায়ের কনজ্যুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড। ভারী শিল্পে নেতৃত্ব দেওয়া এ গ্রুপের অংশীদারি ১৭ শতাংশ বা ১ কোটি ৫৭ লাখ কেজি। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি বা এমজিআই। এই গ্রুপ কিনেছে ৮২ লাখ কেজি চা, যা মোট বাজারের ৯ শতাংশ। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার। তাদের বাজার অংশীদারি সোয়া ৫ শতাংশ। পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে শতবর্ষী এম আহমেদ টি। এ ছাড়া বাজারজাতের জন্য সরাসরি বাগান থেকে সংগ্রহ করেছে ফিনলে টি।

আমদানি ও নিলাম থেকে সংগ্রহ করা চা কোম্পানিগুলো বাজারজাতের পর খুচরা বিক্রেতারা ভোক্তার কাছে এই চা-পাতা বিক্রি করেন। এতে আরেক দফা মূল্য সংযোজিত হয়। বাজারে সাধারণ মানের খোলা চা বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৩০০-৪০০ টাকায়। তবে ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলোর প্যাকেটজাত ৪০০ গ্রামের চা-পাতা ২১০ টাকা বা কেজি হিসেবে ৫২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে সিংহভাগ প্যাকেটজাত চা প্রতি কেজি ৫২৫ টাকা। প্রিমিয়াম চায়ের দাম আরও বেশি। গড়ে প্রতি কেজি ৫০০ টাকা হিসাবে খুচরায় চায়ের বাজারের আকার দাঁড়াচ্ছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা।

পানীয় হিসেবেই বড় বাজার

ভোক্তার কাপে ওঠার পরই এই পানীয়ের বাজারের আকার সবচেয়ে বেশি বাড়ে। চা-পাতা পানীয় হিসেবে দুইভাবে পরিবেশিত হয়। লিকার চা ও দুধ-চিনি মিশিয়ে তৈরি চা। সাধারণ লিকার চা তৈরির জন্য সবচেয়ে আদর্শ হলো দুই গ্রাম চা-পাতা।

কোম্পানিগুলো ব্ল্যাক টি বা কালো রঙের চায়ের যে ব্যাগ বিক্রি করে, তাতেও দুই গ্রাম চা-পাতা থাকে। ভেষজ চায়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যাগে থাকে দেড় গ্রাম চা। আর গ্রিন টির ব্যাগে থাকে আরও কম—১ দশমিক ৪০ গ্রাম।

চা খাতের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা জানান, লিকার চা ছাড়া দুধ-চিনি মিশিয়ে তৈরির জন্য আরও বেশি পাতা দিতে হয়। কড়া লিকারের চায়ের ক্ষেত্রে পাঁচ গ্রাম পর্যন্ত পাতা দরকার হতে পারে। অর্থাৎ হালকা থেকে কড়া লিকারের দুধ চা তৈরিতে ন্যূনতম আড়াই থেকে পাঁচ গ্রাম পর্যন্ত পাতা দরকার।

চা বোর্ড ও নিলাম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাথমিক হিসাবে, গত মৌসুমে চা-পাতা বাজারজাত হয়েছে ৯ কোটি ১২ লাখ কেজি। গড়ে আড়াই গ্রাম হিসাবে ধরা হলে এই চা-পাতা দিয়ে কমবেশি ১০ কোটি কাপ চা তৈরি হয়। গত বছর জাতীয় চা দিবসে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও বলেছেন, দেশের মানুষ বছরে ১০ কোটি কাপ চা পান করেন।

হোটেল-রেস্তোরাঁয় প্রতি কাপ চা বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১৫ টাকায়। এ ক্ষেত্রে লিকার চা প্রতি কাপের দাম ৮ থেকে ১০ টাকা। তবে দুধ-চিনি মিশিয়ে তৈরি চা বিক্রি হয় প্রতি কাপ ১২ থেকে ১৫ টাকা। চট্টগ্রামের বায়েজিদ সড়কের রাসেল টি কর্নারের বিক্রেতা মো. রাসেল প্রথম আলোকে জানান, দুধ ও চিনির দাম বাড়ানোর কারণে প্রতি কাপ চায়ের দাম বেড়েছে।

গড়ে প্রতি কাপ ১০ টাকা ধরা হলেও পানীয় হিসেবে গেল মৌসুমে চায়ের বাজারের আকার দাঁড়াচ্ছে প্রায় সাড়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। দিনে গড়ে ১০০ কোটি টাকা।

লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটির গত বছর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তিন বছরে গড়ে বাংলাদেশে জনপ্রতি চা-পাতার ভোগ ছিল ৪৮০ গ্রাম। এরপর ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে গড়ে এই ভোগ দাঁড়িয়েছে ৫২০ গ্রাম। ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি গত বছরের হিসাব এখনো প্রকাশ করেনি। চা বোর্ড ও নিলাম পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর হিসাবে ২০২১-২২ মৌসুমের তুলনায় ২০২২-২৩ মৌসুমে চায়ের ভোগ ৩ শতাংশ কমেছে। তবে চায়ের ভোগ কমলেও উপকরণ দুধ-চিনির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাজার ছোট হয়নি।

আরও পড়ুন