গরুর অঙ্গও দামি রপ্তানি পণ্য
গরুর লিঙ্গ (বুলস্টিক) দিয়ে বানানো হয় কুকুরের খাবার। এ পণ্যের বড় বাজার রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়।
গরু জবাই শেষে মাংস সংগ্রহের পর অধিকাংশ অবশিষ্টাংশের জায়গা হয় ময়লার ডাস্টবিন বা ভাগাড়ে। তবে পশুর যৌনাঙ্গ, রক্ত, হাড়, শিং, ভুঁড়ি, লেজের লোম ও চর্বি কোনো কিছুই ফেলনা নয়। সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের রয়েছে নানা ব্যবহার ও বাণিজ্যিক মূল্য। গরুর লিঙ্গ দিয়ে বানানো হয় কুকুরের খাবার। তাই বিদেশে এই পণ্যের চাহিদা ব্যাপক।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে মোট নয়টি প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়াজাত বুলস্টিক রপ্তানি করছে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে শুধু মে মাসে ১৪ হাজার ৭৫২ কেজি বুলস্টিক রপ্তানি করেছে ৫টি প্রতিষ্ঠান। যার বাজারমূল্য ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, এই পণ্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। বাকি ৪০ শতাংশ কানাডায়। মান ও প্রকারভেদে প্রতি কেজি বুলস্টিকের দাম ১৮ থেকে ৩৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত। যেহেতু এই পণ্যের প্রধান রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র, তাই পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা এই পণ্যের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
গরু ও মহিষের বুলস্টিক (ষাঁড়গরুর যৌনাঙ্গ) থেকে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায় এ নিয়ে হয়তো খুব বেশি মানুষ ভাবেননি। তবে এর মধ্যেও ২০২৩–২৪ অর্থবছরে প্রায় ২০ কোটি টাকার বুলস্টিক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৫৩৭ কেজি বুলস্টিক রপ্তানি হয়। যার ৯৫ শতাংশই গরুর। সে বছর অপ্রচলিত এই পণ্য রপ্তানি
করে বাংলাদেশ ৩৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা আয় করে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ধরনেরপণ্য রপ্তানিতে আগে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রণোদনা থাকলেও এখন তা কমে নেমে এসেছে ৬ শতাংশে। এ কারণে এই পণ্য রপ্তানিতে অনেকে আগ্রহ হারিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকদের দাবি, চীনের কিছু ব্যবসায়ী এই পণ্য কাঁচা অবস্থায় অল্প দামে রপ্তানি করায় বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি কাঁচামালের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অনেক স্থানীয় ব্যবসায়ী। এ ছাড়া গরু জবাইয়ের আগে বিএসই (বভিন স্পঞ্জিফর্ম এনসেফ্যালোপ্যাথি বা ম্যাডকাউ ডিজিজ) সার্টিফিকেট প্রদান করলে এই পণ্য ইউরোপের বাজারে সহজে রপ্তানি করা সম্ভব। ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করতে পারলে রপ্তানি বেড়ে দ্বিগুণ হবে।
রপ্তানির প্রক্রিয়া কী
গরুর ও মহিষের বুলস্টিক যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের বেশ কিছু দেশে কুকুরের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বে এ ধরনের অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানিতে এগিয়ে আছে ব্রাজিল ও তুরস্ক। তবে এই পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রপ্তানির জন্য বুলস্টিক সংগ্রহের প্রক্রিয়া হিসেবে প্রথমে গরু জবাইয়ের পর লিঙ্গ সংগ্রহ
করে ফ্রিজারে রাখতে হয়। পরে ভালোভাবে ধুয়ে চামড়া ও চর্বি সরিয়ে আলাদা করতে হয় বুলস্টিক। তারপর সেটির মূত্রনালি আলাদা করে আবারও পরিষ্কারের পর রোদে শুকানো হয়। যদিও সূর্যের আলোতে শুকালে আক্রমণ করতে পারে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া। তাই বাণিজ্যিক ওভেনে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ৬০ মিনিট ধরে শুকালে এই পণ্য প্রস্তুত হয়ে যায়। তবে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী এই পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হয়। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, শুকানোর ক্ষেত্রে আর্দ্রতা ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে থাকা জরুরি। পণ্যটি রপ্তানির উপযোগী হওয়ার পর সংগ্রহ করা হয় স্বাস্থ্যসনদ ও রপ্তানির ছাড়পত্র। রপ্তানির জন্য প্রতিটি বুলস্টিক নির্দিষ্ট ওজন ও আকৃতি অনুযায়ী ৬ ও ১২ ইঞ্চি মাপে কেটে ভ্যাকুয়াম প্যাকিং করে রপ্তানি করতে হয়।
কীভাবে সংগ্রহ করা হয় ‘বুলস্টিক’
দেশে প্রতিবছর এক কোটির বেশি গরু ও মহিষ জবাই করা হয়। দেশের প্রায় সব জেলা থেকে গরু ও মহিষের বুলস্টিক সংগ্রহ করেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। গত ছয় বছর ধরে গরুর চামড়া, ভুঁড়ি, বুলস্টিকসহ বিভিন্ন অবশিষ্টাংশের ব্যবসা করেন সাভারের হেমায়েতপুরের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান। প্রতি মাসে তিনি ১৫ থেকে ১৭ হাজার বুলস্টিক সংগ্রহ করেন বরিশাল, কুষ্টিয়াসহ আশপাশের ১৫টির বেশি জেলা থেকে। এসব জেলার কসাইরা প্রতিদিন তাদের জবাই করা গরুর অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করেন। হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গরু–মহিষের অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করে ব্যবসা করে প্রতি মাসে ১ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন তিনি। সাভারে কেজি হিসেবে বিক্রি হয় এই পণ্য। ২৫০ গ্রামের কম ওজনের বুলস্টিক বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি এবং ৩০০ গ্রাম ওজনের বেশি বুলস্টিক বিক্রি হয় ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে। তবে মান ও আকারভেদে দাম কিছুটা কমবেশি হয়।
গরুর বুলস্টিকের আরেক ব্যবসায়ী সিরাজগঞ্জের একরামুল হক। সাত বছর ধরে এই ব্যবসা করে তিনি সাত সদস্যের পরিবার চালাচ্ছেন। প্রতিমাসে প্রায় ৪০ হাজার বুলস্টিক সংগ্রহ করেন একরামুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি মাসে এই ব্যবসা থেকে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় করেন। উত্তরবঙ্গের ২০টি জেলা থেকে এই পণ্য সংগ্রহ করেন তিনি। সব মিলিয়ে সিরাজগঞ্জের ১৮ থেকে ২০ জন ব্যবসায়ী এই ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন। একরামুল হক জানান, প্রতিটি বুলস্টিক তিনি ৬০ থেকে ৭০ টাকায় সংগ্রহ করেন। পরে ৫ থেকে ১০ টাকা লাভে বিক্রি করেন।
রপ্তানির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ১ লাখ ২ হাজার ৮৯ কেজি বুলস্টিক রপ্তানি হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। ২০২২ সাল থেকে বুলস্টিক রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেছে ফ্রন্টিয়ার পেট ফুডস। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে গড়ে দেড় টন বুলস্টিক রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়। ফ্রন্টিয়ার পেট ফুডসের পরিচালক আবিদ আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, এই পণ্য রপ্তানির সঙ্গে জড়িত সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে একটি সমিতি করার চেষ্টা করছি। তাতে এই ব্যবসা পরিচালনা করা আরও সহজ হবে। এই পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা বাড়ানেো হলে অনেকে এই ব্যবসায় যুক্ত হবেন। তিনি আরও বলেন, বুলস্টিক অপ্রচলিত পণ্য হওয়ায় এ ব্যবসায় ব্যাংকঋণ পেতে নানা সমস্যা হয়। সরকার যদি এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসে, তাহলে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন।
এ খাতের রপ্তানিকারক আরেক প্রতিষ্ঠান এম এম রাইয়ান ট্রেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজুল হাসান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করতে জীবাণুনাশক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গামা রেডিয়েশন করতে হয়। এই কাজটি বাংলাদেশে করে দেয় সাভারে অবস্থিত পারমাণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তবে সেখানে এক টন পণ্য পাঠালে কাজটি করতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। এ সময় কমাতে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। পাশাপাশি সঠিক পদ্ধতিতে এই পণ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা গেলে ইউরোপের বাজার ধরা যাবে। আর ইউরোপের বাজারে রপ্তানি শুরু হলে কয়েক বছরের মধ্যে এই রপ্তানি দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উৎপাদন শাখার পরিচালক এ বি এম খালেদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে বিএসই, আইএসও সার্টিফিকেটের জন্য জিএলপিপি (গুড ল্যাবেরেটরি প্র্যাকটিস প্রোগ্রাম) কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পটি পিছিয়ে পড়েছে। বর্তমানে এই খাতে বড় চ্যালেঞ্জ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও এই বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন।