ফ্যানের বাজারে দেশি ব্র্যান্ডের হিস্যা বাড়ছে

দেশে সিলিং ফ্যানের বার্ষিক চাহিদা ৫০-৬০ লাখ। গড় মূল্য আড়াই হাজার টাকা ধরলে শুধু সিলিং ফ্যানের বাজার ১ হাজার ২৫০ কোটি থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার। আর অন্যান্য ফ্যান হিসাবে নিলে বাজারের আকার দাঁড়ায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা।

গরম আসতে না আসতেই বেড়েছে ফ৵ানের চািহদা। িবক্রয়কেন্দ্রে ফ৵ান দেখছেন একজন ক্রেতা। গতকাল ঢাকার মিরপুরেছবি: প্রথম আলো

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে উষ্ণতা বাড়ছে। বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছে। গ্রীষ্মকালে ঘন ঘন দাবদাহে হাঁসফাঁস অবস্থা তৈরি হচ্ছে। সে জন্য বৈদ্যুতিক পাখা বা ফ্যানের ব্যবহার বাড়ছে। এ ছাড়া দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কারণেও প্রতিবছর বাড়ছে হচ্ছে ফ্যানের চাহিদা। একসময় নন-ব্র্যান্ড ও আমদানি করা ফ্যানে বাজার সয়লাব ছিল। এখনকার চিত্র অবশ্য ভিন্ন। উন্নত মানের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে ফ্যানের বাজারে দেশীয় ব্র্যান্ডের হিস্যা বাড়ছে।

ফ্যান উৎপাদনকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, দেশে সিলিং ফ্যানের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া কয়েক বছর ধরে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় রিচার্জেবল টেবিল এবং ওয়াল ফ্যানের বিক্রিও বেড়েছে। এ ছাড়া টেবিল, স্ট্যান্ড, এগজস্ট, মেগাসহ প্রায় সব ধরনের ফ্যান দেশেই তৈরি হচ্ছে। প্রতিবছর ফ্যানের ব্যবসা বাড়ছে ১০-১৫ শতাংশ হারে। যদিও দুই বছর ধরে অর্থনৈতিক সংকটে অনেক কোম্পানির ফ্যান বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম হয়েছে। তবে বাংলাদেশের ফ্যানের বাজার সম্ভাবনাময়।

দেশে ফ্যানের বাজার কত বড়, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি কোম্পানি জানায়, সিলিং ফ্যানের বার্ষিক চাহিদা ৫০-৬০ লাখ পিছ। গড় মূল্য আড়াই হাজার টাকা ধরলে শুধু সিলিং ফ্যানের বাজার ১ হাজার ২৫০ কোটি থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য ফ্যান হিসাবে নিলে বাজারের আকার দাঁড়ায় ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে এই বাজারের প্রায় অর্ধেক দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর দখলে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই দশক আগেও বাজারে নন-ব্র্যান্ডের ফ্যানের একচ্ছত্র রাজত্ব ছিল। পাশাপাশি পাকিস্তান, ভারত ও চীন থেকে আমদানি হয়ে আসত বিভিন্ন ধরনের ফ্যান। বাজারের আকার বাড়তে থাকায় ইলেকট্রনিকস খাতের বড় কোম্পানিগুলো ফ্যান উৎপাদনে যুক্ত হয়। বর্তমানে আরএফএল, ওয়ালটন, বিআরবি, সুপারস্টার, কনকা, যমুনা, এনার্জিপ্যাকসহ বিভিন্ন দেশীয় ব্র্যান্ডের দখলে আছে ফ্যানের বাজারের প্রায় ৫০ শতাংশ। এতে বিদেশ থেকে আমদানি কমেছে। 

ইলেকট্রনিক পণ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড ওয়ালটন। ১৯৯৯ সালে চীন থেকে আমদানি করা টেলিভিশন বিক্রির মাধ্যমে ওয়ালটন ইলেকট্রনিকসের বাজারে যাত্রা শুরু করে। ২০০৫ সালের শেষ দিকে তারা গাজীপুরের কালিয়াকৈরে নিজস্ব জমিতে কারখানা গড়ে তোলে। সেই কারখানায় বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০০৮ সালে, ফ্রিজ দিয়ে। পরে ফ্যানও উৎপাদনে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।

ছয়-সাত মাস আগে বিএলডিসি (ব্রাশ লেস ডিসি মোটর) প্রযুক্তির বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ফ্যান বাজারজাত শুরু করেছে ওয়ালটন। বাজারে গতানুগতিক ফ্যান ৮০-১০০ ওয়াটের। আর বিএলডিসি প্রযুক্তির ফ্যান ৩৫ ওয়াটের, যা কিনা ৬৫ শতাংশ বিদ্যুৎসাশ্রয়ী। এই ফ্যান ৫ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করছে ওয়ালটন। এই ফ্যানে পাঁচ বছরের বিক্রয়োত্তর সেবাও দিচ্ছে তারা।

ওয়ালটন ইলেকট্রিক্যাল অ্যাপ্লায়েন্সের হেড অব বিজনেস সোহেল রানা বলেন, বাসায় তিনটি সাধারণ ফ্যান যদি দিনে গড়ে ১০ ঘণ্টা চলে তাহলে বছরে বিদ্যুৎ খরচ হবে ৭ হাজার ৫৬০ টাকা (প্রতি ইউনিট ৭ টাকা ধরে)। সেখানে বিএলডিসি ফ্যান ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ খরচ কমে ২ হাজার ৬৪৬ টাকা হবে। ধরা যাক, দেশে ৫ কোটি সাধারণ ফ্যান ব্যবহার করা হয়। এতে প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। সাধারণ ফ্যানের পরিবর্তে বিএলডিসি ফ্যান ব্যবহৃত হলে ৩ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে বিএলডিসি ফ্যান ক্রয়ে ক্রেতাদের যে ব্যয় করতে হয়, তা এক বছরের মধ্যেই বিদ্যুৎ খরচ সাশ্রয়ের মাধ্যমে উঠে আসে।

ফ্যানের বাজারে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশীয় আরেক প্রতিষ্ঠান আরএফএল গ্রুপ। ভিশন ও ক্লিক নামে তাদের ফ্যানের দুটি ব্র্যান্ড রয়েছে। প্রচলিত ফ্যানের পাশাপাশি বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বিএলডিসি প্রযুক্তির ফ্যানও বিক্রি করছে তারা। তাদের সিলিং ফ্যানের দাম ৩ হাজার ২০০ টাকা থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত।

জানতে চাইলে আরএফএল ইলেকট্রিক্যাল অ্যাপ্লায়েন্সের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মো. রাশেদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফ্যানের চাহিদা বাড়ছে। তা ছাড়া গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় পণ্যটির বিক্রি বেড়েছে। বর্তমানে আমরা বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ফ্যান উৎপাদনে বেশি জোর দিচ্ছি। তার মধ্যে বিএলডিসি প্রযুক্তির ফ্যানও রয়েছে। কারণ, বিদ্যুতের খরচ বাড়ছে। ফলে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী পণ্যের চাহিদা বাড়ছে সবার মধ্যে।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে মো. রাশেদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ফ্যান উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণের ৮০-৮৫ শতাংশই আমদানি করতে হয়। তাই ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ফলে পণ্যের দামও কিছুটা বাড়াতে হয়েছে। তবে খরচ যে হারে বেড়েছে, সেই হারে ফ্যানের দাম বাড়ানো হয়নি।

দেশে কনকা ব্র্যান্ডের সিলিং ফ্যান উৎপাদন করছে ইলেকট্রো মার্ট। তাদের উৎপাদিত বর্তমানে ৪৬ ইঞ্চি থেকে ৫৬ ইঞ্চি ফ্যানের দাম ২ হাজার ৩৯০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৪৮০ টাকা। এসব ফ্যান বিদ্যুৎসাশ্রয়ী।

 ইলেকট্রো মার্ট গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আফসার বলেন, ‘বিক্রয়কেন্দ্রে এসে গ্রাহকেরা যাতে সব পণ্যই কিনতে পারেন, এই ধারণা থেকেই আমরা ফ্যান উৎপাদন শুরু করি। তবে ফ্যানের বাজার দিন দিন বড় হচ্ছে। আমরা মানসম্মত বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ফ্যান উৎপাদন করছি। ভবিষ্যতে সিলিং ফ্যান ছাড়াও অন্যান্য ফ্যান উৎপাদনের দিকে যাব।’

ফ্যানের বাজারে আরেক বড় ব্র্যান্ড সুপারস্টার। ২০১২ সালে ফ্যান উৎপাদন শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে সিলিং, এগজস্ট ও বিভিন্ন ধরনের টেবিল ফ্যান তৈরি করছে তারা। তারা বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বিএলডিসি ফ্যান সরকারি প্রকল্প ও করপোরেট পর্যায়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া ফ্যানের হাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে সরবরাহে নতুন প্রযুক্তির ফ্যান বাজারে আনতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

সুপারস্টারের হেড অব মার্কেটিং অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যত বাড়বে, ততই হোম অ্যাপ্লায়েন্স ব্যবহার বাড়বে। একই সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তির পণ্যের চাহিদাও বাড়বে। দেশে ফ্যানের বাজার আরও বড় হবে। ফলে আমরা নিত্যনতুন প্রযুক্তির পণ্য নিয়ে আসতে কাজ করছি।’