১২ মাসে আকিজ রিসোর্স নতুন ৪ ব্যবসায়

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ তলানিতে নেমেছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতেও গত ১২ মাসে পোলট্রি ও প্রাণী খাদ্য, হালকা প্রকৌশল, ফার্মেসি ও জবস—এই চার নতুন ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে আকিজ রিসোর্স গ্রুপ। এসব খাতে গ্রুপটি বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এতে নতুন করে দেড় হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আরও কয়েকটি নতুন ব্যবসা নিয়ে আসার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এই শিল্পগোষ্ঠী।

২০২০ সালের এপ্রিলে আকিজ রিসোর্স গ্রুপ নামে তাদের আলাদা ব্যবসা শুরু করে। তার আগে তারা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া আকিজ গ্রুপের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। ২০২০ সালে আলাদা ব্যবসা শুরুর আগে আকিজ রিসোর্স গ্রুপ উত্তরাধিকারসূত্রে আকিজ সিমেন্ট, শিপিং ও ভোগ্যপণ্যের ট্রেডিং ব্যবসা পেয়েছিল। আলাদা ব্যবসা শুরুর পর দ্রুতই ব্যবসা সম্প্রসারণ শুরু করেন গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শেখ জসিম উদ্দিন।

বর্তমানে আকিজ রিসোর্স গ্রুপের নির্মাণসামগ্রী, ট্রেডিং, তথ্যপ্রযুক্তি, ভোগ্যপণ্য, শিপিং, হালকা প্রকৌশলসহ ১১ খাতে ব্যবসা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৫। প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজ করেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে আকিজ রিসোর্স গ্রুপের লেনদেন ছিল প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।

আগামী বছরগুলোয় নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনার কথা জানালেন শেখ জসিম উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশ ঘনবসতিপূর্ণ। নিত্যপণ্যের চাহিদা রেকর্ড ছুঁয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এই বাস্তবতায় দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগে যেখানে বিশাল জনগোষ্ঠীকে সরাসরি সম্পৃক্ত করা সম্ভব, এমন খাতে কৌশলগত বিনিয়োগ জরুরি। সে জন্য আমরা বড় আকারে খুচরা বা রিটেইল ব্যবসায় আসার পরিকল্পনা করছি। আমরা স্বপ্ন দেখি, একদিন ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করব।’

শেখ জসিম উদ্দিনের বাবা আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত শেখ আকিজ উদ্দিন প্রায় আট দশক আগে কলকাতার হাওড়া স্টেশনে জীবনসংগ্রাম শুরু করেছিলেন। মূলত তিনি খুলনার ফুলতলা থেকে উঠে আসা একজন বাংলাদেশি শিল্পপতি। পঞ্চাশের দশক থেকেই নানা ধরনের ব্যবসা করেছেন। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একের পর এক ব্যবসা বাড়িয়েছেন, বড় শিল্পপতি হয়েছেন। রাজধানীতে থিতু হয়েছেন অনেক পরে। যে কয়েকজন উদ্যোক্তা বাংলাদেশকে শিল্পায়নের পথে নিয়ে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শেখ আকিজ উদ্দিন।

প্রয়াত শেখ আকিজ উদ্দিনের ১৫ জন সন্তান। ১০ ছেলে ও ৫ মেয়ে। আকিজ উদ্দিনের ছেলেরাই শুধু ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন। নব্বইয়ের দশকে ১০ সন্তানের মধ্যে ব্যবসা ভাগ করে দেন আকিজ উদ্দিন নিজেই। ছেলেদের মধ্যে শেখ নাসির উদ্দিন, শেখ বশিরউদ্দীন, শেখ জামিল উদ্দিন, শেখ জসিম উদ্দিন ও শেখ শামীম উদ্দিন একসঙ্গে ব্যবসা করতেন। পাঁচ বছর আগে একক নেতৃত্ব ব্যবসা শুরু করতে থাকেন তাঁরা।

শেখ নাসির উদ্দিন আকিজ গ্রুপ, শেখ বশিরউদ্দীন আকিজ বশির গ্রুপ, শেখ জামিল উদ্দিন আকিজ ইনসাফ, শেখ জসিম উদ্দিন আকিজ রিসোর্স গ্রুপ এবং শেখ শামীম উদ্দিন গড়ে তোলেন আকিজ ভেঞ্চার লিমিটেড। তাঁদের মধ্যে শেখ বশিরউদ্দীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে আকিজ বশির গ্রুপের এমডি পদ ছাড়েন।

আকিজ রিসোর্সের শুরু

আকিজ গ্রুপ থেকে আকিজ রিসোর্স শিপিং, সিমেন্ট, রেডিমিক্স, পলি ফাইবার কারখানা এবং কয়েকটি ট্রেডিং ব্যবসা পেয়েছিল। এগুলোর মধ্যে জাহাজের ব্যবসা সবচেয়ে বড়। তাদের ১০টি মাদার ভ্যাসেল বা বড় জাহাজ এবং ৪২টি ফিডার ভ্যাসেল বা ছোট জাহাজ রয়েছে। নতুন যাত্রা শুরু করার পর থেকেই নতুন নতুন বিনিয়োগে নজর দেন শেখ জসিম উদ্দিন। চালকল, স্টিল কারখানা, ময়দা ও ডাল মিল, শর্ষের তেল, নতুন ট্রেডিং ব্যবসা ও সেবা খাতে বিনিয়োগ করে। এসব ব্যবসায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করা হয়।

আকিজ রিসোর্সের কর্মকর্তারা জানান, করোনার পরপর প্রায় ৪৫০ কোটি টাকায় মুন্সিগঞ্জের ম্যাগনাম স্টিল অধিগ্রহণ করে আকিজ রিসোর্স গ্রুপ। বর্তমানে কারখানাটি আকিজ ইস্পাত নামে পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া ২০২৩ সালে প্রায় ৮০ কোটি টাকায় নওগাঁয় রাবেয়া অটো রাইস মিল ও কফিল অ্যান্ড রাজ্জাক অ্যাগ্রো লিমিটেড নামে দুটি চালকল কিনে নেয়। এর আগে প্রায় ৩০০ কোটি টাকায় সজীব গ্রুপের হাশেম রাইস মিলও কিনেছিল আকিজ রিসোর্স।

নতুন খাতে বিনিয়োগ

আকিজ রিসোর্স মুন্সিগঞ্জে আকিজ ফিড কারখানা স্থাপন করে। গত বছরের ডিসেম্বরে কারখানাটিতে পোলট্রি, গবাদিপশু ও মৎস্য চাষের জন্য ফিড বা খাবার উৎপাদন শুরু হয়। কারখানাটির মাসিক উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার টন। তবে আট মাসের মধ্যে মাসিক বিক্রি ১০ হাজার টনে পৌঁছেছে বলে জানালেন আকিজ রিসোর্সের কর্মকর্তারা।

এদিকে গত জুনে ফার্মেসিতে বিনিয়োগ শুরু করে আকিজ রিসোর্স। এখন পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তাদের ১২টি ফার্মেসি চালু হয়েছে। আগামী দুই বছরে ৫০০ ফার্মেসি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে গ্রুপটির। আকিজ ফার্মেসি নামে ওষুধের বিক্রয়কেন্দ্রগুলো হচ্ছে নিজস্ব মালিকানায়।

এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের বন্দরে হালকা প্রকৌশল পণ্যের একটি কারখানা করেছে আকিজ রিসোর্স। এ কারখানায় আটটি ভিন্ন শ্রেণির পণ্য তৈরি হচ্ছে। এই কারখানায় উৎপাদিত পণ্য—ইলেকট্রিক্যাল, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ওয়াটার পাম্প ও টুলসের ফ্ল্যাগশিপ ব্র্যান্ড ‘ইনোভার’ নিয়ে এসেছে গ্রুপটি। এখন পর্যন্ত হালকা প্রকৌশল খাতে ১ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আগামী তিন বছরে আরও ৭ হাজার কর্মসংস্থান হবে বলে জানালেন গ্রুপ-সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ আকিজ রিসোর্স চাকরি খোঁজার প্ল্যাটফর্ম নেক্সট জবস চালু করেছে গত মাসে। এটি চাকরির পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়ন, ক্যারিয়ার গাইডেন্স এবং করপোরেট নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগ দেবে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের জন্যও কর্মী নিয়োগ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আকিজ রিসোর্স।

নতুন বিনিয়োগের বিষয়ে সম্প্রতি নিজেদের কার্যালয়ে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন আকিজ রিসোর্স গ্রুপের চিফ বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অফিসার মোহাম্মদ তৌফিক হাসান। তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রুপের এমডি ২০২১ সালে একটি ব্যবসায়িক কৌশলপত্র চূড়ান্ত করেন। সেই কৌশলপত্র ধরেই বিনিয়োগ করছে আকিজ রিসোর্স গ্রুপ। গত এক বছরে আমরা পোলট্রি ও প্রাণী খাদ্য, হালকা প্রকৌশল, ফার্মেসি ও জবস—এই চার খাতে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। তবে শুধু একটি পণ্য নয়, বরং একটি ইকোসিস্টেম নিয়ে আকিজ রিসোর্স কাজ করছে।’

নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা

ফার্মেসির পাশাপাশি ডায়াগনস্টিক ও কনসালটেশন সেন্টার করার উদ্যোগ নিয়েছে আকিজ রিসোর্স গ্রুপ। যেখানে মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে পারবেন। প্রথম সেন্টারটি হবে মিরপুরে। এ ছাড়া চিকিৎসা যন্ত্রপাতি উৎপাদনের পরিকল্পনাও করছে গ্রুপটি।

আকিজ রিসোর্সের একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে চিকিৎসা যন্ত্রপাতির বাজার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। তার মধ্যে বড় অংশই আমদানি করতে হয়। সে কারণে দেশে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি উৎপাদনে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় কীটনাশক ও রাসায়নিক এবং সার উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে আকিজ রিসোর্স গ্রুপ। পাশাপাশি শহরজুড়ে ছোট ছোট সুপারশপ করার চিন্তাভাবনা রয়েছে।

সরকার ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। গত নভেম্বরে ‘মুনাফা ইসলামিক ডিজিটাল ব্যাংক’ নামে ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে আকিজ রিসোর্স।

বর্তমান অস্থির সময়ে বড় বিনিয়োগের বিষয়ে মোহাম্মদ তৌফিক হাসান বলেন, ‘আমাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনাগুলো আগে থেকে চলছিল। যেমন চার বছর ধরে কাজ করার পর গত বছর আমরা ফিড মিল চালু করতে পেরেছি। আমাদের প্রতিটি বিনিয়োগের একটি পথনকশা রয়েছে।’

৩ বছর ধরে আমরা নতুন নতুন ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছি

আকিজ রিসোর্স গ্রুপের এমডি ও সিইও শেখ জসিম উদ্দিন

আকিজ রিসোর্স গ্রুপের এমডি ও সিইও শেখ জসিম উদ্দিন বলেন, আকিজ রিসোর্স মূলত আকিজ গ্রুপ থেকে সৃষ্টি হওয়া একটি শিল্পগ্রুপ। ২০২০ সালের ২৬ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে আকিজ রিসোর্স। সে সময় আকিজ রিসোর্সের অধীনে প্রতিষ্ঠান ছিল চার-পাঁচটি। যাত্রা শুরুর পর আমরা বাস্তবসম্মত ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক কৌশল অবলম্বন করি। এর ফলে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে ২০২২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আকিজ রিসোর্স নতুন নতুন ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে।

শেখ জসিম উদ্দিন আরও বলেন গত তিন বছরে আমরা বিভিন্ন খাতে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। আগামী সাত বছরের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। তার মধ্যে তিন বছরেই বিনিয়োগ হবে ৬ হাজার কোটি টাকা। মূলত সিমেন্ট, ইস্পাত, কেব্‌লস, প্যাকেজিং ও স্বাস্থ্য খাতের ব্যবসা সম্প্রসারণে এই বিনিয়োগ করা হবে।

আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে টেকসই বিনিয়োগ, জনশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার ও ভোক্তার আস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে এশিয়ায় একটি ব্র্যান্ড পরিণত হতে কাজ করছে আকিজ রিসোর্স গ্রুপ, এমনটা জানিয়ে শেখ জসিম উদ্দিন বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের গ্রুপে কর্মসংস্থান হয়েছে ১০ হাজার মানুষের। আগামী তিন বছরে আরও ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আমার স্বপ্ন, আকিজ রিসোর্সে একদিন মোট ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।