শুরুতে পিছিয়ে থাকলেও ভরা মৌসুমে এগিয়ে গেছে চা উৎপাদন 

জানুয়ারি-জুলাই মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪.৬০% বা ১৭ লাখ ৬৬ হাজার কেজি চা বেশি উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে।

ফাইল ছবি

মৌসুমের শুরুতে খরা ও অপর্যাপ্ত বৃষ্টির কারণে চায়ের উৎপাদন কমে যায়। তাতে বাগানমালিকদের মধ্যে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা দেয়। তবে জুলাই মাসে আবহাওয়া অনুকূল থাকায় চায়ের উৎপাদন আবার যেন গতি ফিরে পায়। পিছিয়ে থেকে মৌসুম শুরু হলেও জুলাই মাসে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি বছরে চা উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত চা উৎপাদিত হয়েছে চার কোটি কেজি। ২০২২ সালে একই সময়ে উৎপাদিত হয়েছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ কেজি। অর্থাৎ এবার জানুয়ারি–জুলাই মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ বা ১৭ লাখ ৬৬ হাজার কেজি চা বেশি উৎপাদিত হয়েছে। এতে শুধু গত বছরই নয়; বরং দেশে চা উৎপাদনের ইতিহাসে এযাবৎকালে বছরের প্রথম সাত মাসে এটিই সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড।

খরার পর বৃষ্টি হলে চায়ের উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। এবার জুলাই মাসে রেকর্ড উৎপাদন হওয়াটা তারই প্রতিফলন। জুলাই মাসের মতো উৎপাদন অব্যাহত থাকলে বছর শেষে ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের মাইলফলক অতিক্রম করা সম্ভব হবে।
মুনির আহমেদ, সাবেক উপপরিচালক, বাংলাদেশ চা বোর্ড

চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম ধরা হয় জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসকে। এ সময়ে প্রতি মাসে এক কোটি কেজির বেশি চা উৎপাদিত হয়। এবার ভরা মৌসুমের শুরুতে জুন মাসে চা–বাগান এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টি ছিল কম। তাপমাত্রাও ছিল বেশি। দুটিই চায়ের ফলনের জন্য ক্ষতিকর। এ রকম বিরূপ আবহাওয়ার কারণে গত জুন মাসে চায়ের উৎপাদন কমে এক কোটি কেজিতে নেমে আসে। গত বছরের একই মাসে উৎপাদিত হয়েছিল ১ কোটি ২৫ লাখ কেজি।

তবে জুলাইয়ে উৎপাদন বেড়েছে অন্য সময়ের তুলনায় বেশি। এই মাসে চা উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৩৬ লাখ কেজি, যা গত বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি। মূলত এক মাসে রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদনের কারণেই প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে চায়ের উৎপাদন। চা বোর্ড এ বছর ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।

চা–বাগানমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, চা–বাগানে নিয়মিত নতুন চারা লাগানো, সংস্কার কার্যক্রমসহ যে বিনিয়োগ হচ্ছে, তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে এখন। তবে মৌসুমের শুরুতে খরার কারণে চায়ের ফলন কমে যায়। আবার জুলাই মাসে অনুকূল আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন বেড়েছে। মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। আগামী অক্টোবর পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূল থাকলে উৎপাদনে রেকর্ড হতে পারে।

চায়ের উৎপাদন বাড়ায় প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় এখন চা উৎপাদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি। এক বছর আগের তুলনায় গত জুন পর্যন্ত ভারতে চায়ের উৎপাদন কমার হার ছিল ২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় অবশ্য উৎপাদন বাড়ে প্রায় ১ শতাংশ বেশি। কেনিয়ায় মে মাস পর্যন্ত উৎপাদনের তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানে উৎপাদন ১ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে জুলাই পর্যন্ত চায়ের উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের সাবেক উপপরিচালক মুনির আহমেদ গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, খরার পর বৃষ্টি হলে চায়ের উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। এবার জুলাই মাসে রেকর্ড উৎপাদন হওয়াটা তারই প্রতিফলন। জুলাই মাসের মতো উৎপাদন অব্যাহত থাকলে বছর শেষে ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের মাইলফলক অতিক্রম করা সম্ভব হবে। মুনির আহমেদ বর্তমানে একটি চা–বাগানের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এদিকে চায়ের উৎপাদন বাড়লেও নিলামে দাম কমে যাওয়া নিয়ে হতাশ বাগানমালিকেরা। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত নিলামের তথ্যে দেখা যায়, এ বছরের ১৭টি নিলামে চায়ের প্রতি কেজির গড় দাম পাওয়া গেছে ২০৫ টাকা ৩১ পয়সা। গত বছরের একই সময়ে দাম ছিল ১৯৯ টাকা ২২ পয়সা। অর্থাৎ গড়ে প্রতি কেজিতে ছয় টাকা বেশি দাম পাওয়া গেছে। নিলাম সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে গড় দাম ভালো পাওয়া গেলেও গত কয়েকটি নিলামে দাম কমছে। যেমন এক সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠিত ১৭তম নিলামে গড়ে প্রতি কেজি চা বিক্রি হয়েছে ১৯০ টাকায়। গত বছরের একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল গড়ে প্রায় ২০৮ টাকায়। 

বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শাহ আলম বলেন, চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়াটা ইতিবাচক। তবে নিলামে ভালো দাম না পেলে এই শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, এখন যে দাম পাওয়া যাচ্ছে, তাতে উৎপাদন খরচ উঠছে না। উৎপাদন খরচ না উঠলে চা–বাগানে বিনিয়োগও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সাত জেলায় চায়ের আবাদ হচ্ছে। জেলাগুলো হচ্ছে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান ও পঞ্চগড়। এসব জেলায় ১৬৮টি চা–বাগানে ও সমতলে ক্ষুদ্রায়তনে চা চাষ হয়। গত বছর ১ লাখ ৬৪ হাজার একর জমিতে চায়ের আবাদ হয়। তাতে চা উৎপাদিত হয় ৯ কোটি ৩৮ লাখ কেজি। চা বিপণনের নিয়মানুযায়ী, বাগান থেকে চা–পাতা তুলে কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে দানাদার চা তৈরির পর তা নিলামে নিয়ে বিক্রি করতে হয়।