‘চামড়ার বাজারে প্রতিযোগিতা আছে, কারও লোকসানের আশঙ্কা কম’

এবারের কোরবানির মৌসুমে গরুর চামড়ার দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আরও দাম প্রত্যাশা করেছিলেন। কারণ, তাঁরা সরকারের নির্ধারিত দাম পাননি। আর এ বছর তো ছাগলের চামড়ায় কোনো আগ্রহই দেখা যাচ্ছে না আড়তদারদের। কোরবানির পশুর চামড়া ব্যবসা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি আফতাব খান। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম

আফতাব খান, সভাপতি, বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ)
ছবি– প্রথম আলো।
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ঈদের প্রথম দুই দিনে কী পরিমাণে চামড়া সংগ্রহ করতে পেরেছেন?

আফতাব খান: শুধু পোস্তার আড়তগুলোতে ৭০ হাজার চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য ছিল। সম্ভবত এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। বাকিটাও কালকের মধ্যে হয়ে যাবে। এর মধ্যে গতকাল ঈদের দিনে ৮০ শতাংশ চামড়া আমরা পেয়েছি। ১৫ শতাংশ আজ আসবে। বাকি ৫ শতাংশ আগামীকাল পাব বলে আশা করছি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: গত বছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য এবার কিছুটা কম হলো কিনা?

আফতাব খান: সার্বিক হিসাব করলে বলা যায় লক্ষ্য কমেনি। বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি। গত বছর পোস্তায় আমরা ১ লাখ ৪০ হাজার চামড়া সংগ্রহ করে লবণজাত করেছিলাম। এবারও শুরুতে এ রকম লক্ষ্য ছিল। কিন্তু অত্যধিক গরম ও ঈদের আগে বৃষ্টির কারণে সেই লক্ষ্য কমিয়ে এনেছি। পোস্তায় আড়তগুলোর চামড়া লবণজাতকরণের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে বেশি মাত্রায় লবণজাত করলে চামড়া নষ্ট হতে পারে। গত বছরও কিছু চামড়া নষ্ট হয়েছিল। তাই শুধু পোস্তার জন্য এবার ৭০ হাজার চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য ছিল।

পোস্তা এলাকার বাইরে আমাদেরই প্রতিনিধিরা রাজধানীর বেড়িবাঁধ, কৃষি মার্কেট, হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগর এলাকা, জাজিরাসহ বিভিন্ন জায়গায় চামড়া সংগ্রহ করে লবণজাত করেছেন। তাঁদের সবারটা হিসাব করলে দেখা যাবে গত বছরের মতোই চামড়া সংগ্রহ হচ্ছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ঢাকার বাইরের লবণ দেওয়া চামড়া কবে থেকে আসা শুরু হবে?

আফতাব খান: সরকারি নির্দেশনা রয়েছে, এ বছর কোরবানির সাত দিন পর ঢাকার বাইরের কোরবানির পশুর চামড়া ঢাকায় প্রবেশ করতে পারবে। সেই হিসাবে সাত দিন পরেই ঢাকার বাইরের চামড়া আসতে শুরু করবে। অন্যদিকে ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঢাকায় যে চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে, তা ট্যানারিগুলোতে চলে যাবে।

সারা দেশ থেকে যে পরিমাণে লবণ দেওয়া চামড়া ঢাকায় আসে, তার দুই-তৃতীয়াংশই সরাসরি ট্যানারিগুলোতে চলে যায়। বাকি চামড়া পোস্তার ব্যবসায়ীরা কিনে পরে ট্যানারির মালিকদের কাছে বিক্রি করেন।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এ বছর কাঁচা চামড়ার দরদাম কেমন হয়েছে?

আফতাব খান: সরকার লবণ দেওয়া চামড়ার যে দর নির্ধারণ করে দিয়েছে, সে অনুসারেই আমাদের ব্যবসায়ীরা কাঁচা চামড়া কিনেছেন। কারণ, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামেই ট্যানারির মালিকেরা চামড়া কিনবেন। ফলে আড়তদারদের পক্ষে দাম কমিয়ে চামড়া কেনার সুযোগ নেই।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী ও কোরবানিদাতা অভিযোগ করেছেন যে তাঁরা কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি। এ বিষয়ে কী বলবেন?

আফতাব খান: দেখেন, লবণজাতের জন্য আড়তদার ছাড়াও ট্যানারির মালিক, ব্যাপারী, ফড়িয়া ও পাইকারেরা কাঁচা চামড়া কেনেন। ফলে বাজারে একধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে। এ কারণে কেউ কাউকে ঠকিয়ে চামড়া কিনবে, এমন সুযোগ কম। সবারই বাজারে দাম যাচাইয়ের সুযোগ রয়েছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৭-৮টি দাম নেন, এরপর তা যাচাই করে চামড়া বিক্রি করেন। ফলে কারও লোকসানে পড়ার আশঙ্কা কম। আর মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যদি লোকসানই দেন, তাহলে আমাদের চামড়া সংগ্রহের সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ, লোকসান হলে চামড়া সংগ্রহের ব্যাপারে তাঁরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। অন্যদিকে আড়তদারদের লোকসানে পড়ার সুযোগ থেকে যায়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনি বললেন, আড়তদারেরা লোকসানে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে। সেটা কীভাবে?

আফতাব খান: ব্যবসায়ে কেউ লোকসান দেবেন, তা আমাদের কাম্য নয়। যাঁরা মৌসুমি ব্যবসায়ী, তাঁদের বেশির ভাগই লাভে চামড়া বিক্রি করে চলে গেছেন। কিন্তু কারও লবণজাত চামড়ার ১০ শতাংশ নষ্ট হলে মাথায় বাড়ি পড়বে। আর ১৫ শতাংশের বেশি চামড়া নষ্ট হলে পুরো লোকসানে পড়ে যাবে। আবার ট্যানারির মালিকেরা অনেক সময় পণ্য নিতে দেরি করেন। এসব নিয়ে আড়তদারেরা আতঙ্কিত থাকেন।

এ ছাড়া ২০১৫ সাল ও এর আগে থেকে ট্যানারির মালিকদের কাছে অনেক টাকা বকেয়া রয়েছে। কেউ টাকা ফেরত দিয়েছেন, কেউ আংশিক দিয়েছেন, আবার কেউ ফেরত দেননি। সবকিছু মিলিয়ে আমরা ব্যবসাটা চালিয়ে নিচ্ছি। অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। আগে পোস্তায় প্রায় আড়াই শ আড়ত ছিল। এখন সেখানে মাত্র ১৩৪ জন এই ব্যবসায় যুক্ত রয়েছেন।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ঢাকার বাইরে চামড়া সংগ্রহের কী অবস্থা জেনেছেন?

আফতাব খান: ঢাকার বাইরে চামড়ায় লবণ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। তাদের সংগ্রহ ভালো হয়েছে এবং লবণজাতও ভালো করেছে। তবে লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় এ বছর প্রতিটি চামড়ায় বাড়তি ৬০ টাকা খরচ বেড়েছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এ বছর ছাগলের চামড়া কেউ কিনতেই চাননি। ছাগলের চামড়ায় এত অনীহা কেন?

আফতাব খান: আন্তর্জাতিক বাজারেই ছাগলের চামড়ার তেমন চাহিদা নেই। এ কারণে এ বছর গরুর চামড়ার দাম বাড়লেও ছাগলের চামড়ার দাম বাড়ানো হয়নি। তাই ছাগলের চামড়ার প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ নেই। আগে দেশের কিছু বড় ট্যানারি শুধু ছাগলের চামড়াই রপ্তানি করত। কিন্তু এখন এক বর্গফুট ছাগলের চামড়াও রপ্তানি করে না। ছাগলের চামড়ার বৈশ্বিক ফ্যাশন বাজারই চলে গেছে। তারপরও উত্তরবঙ্গের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া শতভাগ সংগ্রহ হয়। কারণ, এই চামড়া আকারে বড় ও ভালো হয়।

কোরবানির সময় অদক্ষ লোকদের দিয়ে ছাগলের চামড়া ছাড়ানো হয়। এটিও ছাগলের চামড়া বিক্রি না হওয়ার একটি বড় কারণ। সারা বছর প্রশিক্ষিত কসাইয়েরা ছাগলের চামড়া ছাড়ান। কিন্তু কোরবানির সময় যাঁরা ছাগল কেনেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরাই ছাগলের চামড়া ছাড়ান। এতে চামড়া নষ্ট হয়ে যায়।