আশুলিয়া ও গাজীপুরে ১৮৩ কারখানা বন্ধ

শ্রম অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

সাভার-আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে শ্রম অসন্তোষ কমছে না। শ্রমিক বিক্ষোভে গতকাল বুধবার ১৮৩টি তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল। এর মধ্যে সাভার-আশুলিয়া-জিরানী এলাকার ৫৪টি ও গাজীপুরের ১২টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ। বাকি ১১৭ কারখানায় শ্রমিকেরা কাজ না করায় ছুটি দেওয়া হয়।

বিক্ষোভের এক পর্যায়ে গতকাল গাজীপুরের কাশিমপুর এলাকায় বিগবস করপোরেশন নামে একটি কারখানার গুদামে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

শ্রম অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সাধারণত পাঁচ বছর পর মজুরি সমন্বয় করা হলেও এবার তা আগেই করার কথা জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গতকাল সচিবালয়ে ‘শ্রম অসন্তোষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক আন্তমন্ত্রণালয় সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

আরও পড়ুন

হাজিরা বোনাস ও টিফিন বিল বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে ৩১ আগস্ট থেকে গাজীপুর ও সাভার-আশুলিয়ায় শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া কারখানায় নিয়োগে নারী ও পুরুষের সম-অধিকার নিশ্চিতের দাবিতেও বিক্ষোভ করেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। মাঝে চার দিন পরিস্থিতি ভালো থাকলেও গত মঙ্গলবার গাজীপুরে আবার শ্রমিক বিক্ষোভ শুরু হয়। গত সোমবার তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা আশুলিয়ার শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস বৃদ্ধিসহ কয়েকটি দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।

বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, সাভার-আশুলিয়ায় ৪৫০ তৈরি পোশাক কারখানা আছে। এর মধ্যে গতকাল ৫৪টি কারখানা অস্থিরতার কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া ৫৭ কারকানার শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েও কাজ না করলে ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে শিল্প পুলিশ জানিয়েছে, গাজীপুরে বিক্ষোভ-আন্দোলনের জেরে ১২টি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আর ছুটি হয়েছে ৬০টি কারখানায়।

গতকাল বিকেলে আশুলিয়ায় কয়েক হাজার সাধারণ শ্রমিকের সঙ্গে বৈঠক করেন বিজিএমইএর নেতারা। বৈঠক শেষে সংগঠনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রমিকেরা কাজ করতে চান, সেটি আমাদের জানিয়েছেন। পরিস্থিতির উন্নতি হলে ধাপে ধাপে কারখানা খুলবেন মালিকেরা।’

আশুলিয়ায় কারখানা বন্ধ

আশুলিয়ার কাঠগড়া থেকে জিরাবো এলাকায় অধিকাংশ পোশাক কারখানা গতকাল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। আজমাত গ্রুপ বন্ধের নোটিশে বলেছে, ‘শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিকে কেন্দ্র করে পোশাক কারখানায় ভাঙচুরসহ হট্টগোল চলছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বুধবার থেকে আজমাত অ্যাপারেলস, জেড-থ্রি কম্পোজিট নিটওয়্যার এবং জি-থ্রি ওয়াশিং প্ল্যান্ট শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো।’

আশুলিয়ার নরসিংহপুর, ইউনিক, জামগড়া ও বেরন এলাকার হা-মীম, শারমিন, এনভয় কমপ্লেক্স, হলিউড গার্মেন্টস, স্টারলিং অ্যাপারেলসসহ অধিকাংশ কারখানা শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় বন্ধ ঘোষণা করেছে। এর ফলে শ্রমিকেরা কাজ না করলে মজুরিও পাবেন না।

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, যারা পারছে তারা কারখানা চালাচ্ছে। যারা পারছে না, তারা ছুটি দিচ্ছে। তবে কোথাও কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

গাজীপুরে কারখানায় আগুন

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, গতকাল সকালে বকেয়া বেতনের দাবিতে গাজীপুরের কাশিমপুরের ভবানীপুর এলাকায় বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের কারখানার শ্রমিকেরা দ্বিতীয় দিনের মতো আন্দোলন শুরু করেন। তাঁরা সড়কও অবরোধ করেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিগবস করপোরেশন কারখানার গুদামে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন গত রাতে বলেন, ‘কারখানায় আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে আমাদের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলের দিকে যায়। শ্রমিকেরা আমাদের একটি গাড়ি ভাঙচুর করলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা চলে আসেন। পরে সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। গুদামে অনেক মালামাল ও ফেব্রিকস ছিল।’

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানা আছে। গত মাসে সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তার হন। বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকেরা আগস্ট মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে কয়েক দিন ধরে কর্তৃপক্ষকে চাপ দিচ্ছিলেন। এমন প্রেক্ষাপটে গত মঙ্গলবার বেতন পরিশোধের আশ্বাস দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। সেদিন কিছু শ্রমিক বেতন পেলেও অধিকাংশই পাননি। সেদিন সন্ধ্যার পর শ্রমিকেরা বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন।

ছয় জেলায় শ্রম অসন্তোষ

গতকাল সচিবালয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে ‘শ্রম অসন্তোষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। সভায় অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান উপস্থিত ছিলেন।

সভায় বলা হয়, ১ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ছয়টি জেলায় শ্রম অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি অসন্তোষের ঘটনা ঘটে গাজীপুরের ২৩৪টি কারখানায়। এ ছাড়া ঢাকায় ১৬৮, নারায়ণগঞ্জে ৩৯, ময়মনসিংহে ২১, চট্টগ্রামে ১৯, পাবনায় ২ ও নরসিংদীতে ১টি কারখানায় অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে।

সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ের শুরুতে বক্তব্য দেন শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম। এরপর ন্যূনতম মজুরি পর্যালোচনাসহ আটটি সিদ্ধান্ত বৈঠক থেকে এসেছে বলে জানান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

অন্য সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা অবিলম্বে পরিশোধের ব্যবস্থা করা, শ্রমসংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা, বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিকদের বকেয়া বেতন দ্রুত পরিশোধ করতে ঋণ বা প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।

শ্রম উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা মানুষের মধ্য থেকে এসেছি। এসেছি মিছিল থেকে। আমরা মাঠপর্যায়ে (কারখানা) যাব। শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলব।’ আগের সরকারের আমলে শ্রম আদালতের প্রতি শ্রমিকেরা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, সে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে তাঁরা কাজ করছেন।