কাজুবাদামে এখন বড় শিল্প গ্রুপ

২০১৬ সালে দেশে প্রথম কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে ওঠে। এরপর কয়েক বছরে ছোট-মাঝারি আকারের অনেক কারখানা চালু হয়। এখন বড় বিনিয়োগ করছে বড় শিল্প গ্রুপ। দেশের চাহিদা মিটিয়ে কাজুবাদাম রপ্তানিতে নাম লেখাতে চায় এসব শিল্প গ্রুপ।

এক দশক আগেও কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতের কোনো কারখানা ছিল না দেশে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সনাতন পদ্ধতিতে খোসা ভেঙে কেউ কেউ বিক্রি করতেন এই বাদাম। ২০১৬ সালে চট্টগ্রামে প্রথম তরুণ উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদের হাত ধরে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে ওঠে। এরপর কয়েক বছরের ব্যবধানে ছোট-মাঝারি আকারের অনেক কারখানা চালু হয়। এখন এই খাতে বড় বিনিয়োগ নিয়ে আসছে বড় শিল্প গ্রুপগুলো। দেশের চাহিদা মিটিয়ে কাজুবাদাম রপ্তানিতে নাম লেখাতে চায় এসব শিল্প গ্রুপ।

কাজুবাদাম শ্রমনির্ভর শিল্প হলেও এখন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। বড় আকারের স্বয়ংক্রিয় কারখানা গড়ে তুলতে অর্ধশত থেকে শতকোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ দরকার। বড় গ্রুপগুলো মূলত স্বয়ংক্রিয় কারখানায় বিনিয়োগ করছে। এসব কারখানায় অন্তত আট ধাপে প্রথমে খোসা ও পরে বাদামের ওপর ডোরাকাটা আবরণ ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। এরপরই খাওয়ার উপযোগী সাদা বাদাম পাওয়া যায়।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে গড়ে প্রতিবছর ৪৫২ কোটি ডলারের কাজুবাদাম রপ্তানি হচ্ছে বিশ্ববাজারে। এর ৯০ শতাংশই রপ্তানি করছে ভিয়েতনামসহ মাত্র ৫টি দেশ। তবে আমদানিকারক দেশের সংখ্যা অনেক। ন্যূনতম কোটি ডলারের কাজুবাদাম আমদানি করছে, এমন দেশের সংখ্যা ৪৫। শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, চীন ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশ। তাই এই বাজারগুলোতে রপ্তানির সম্ভাবনা দেখছেন উদ্যোক্তারা।

‘কাজুবাদাম সম্ভাবনাময় খাত। দেশীয় বাজারে চাহিদা বাড়ছে। আবার রপ্তানিতে ভিয়েতনাম ও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা রয়েছে আমাদের। এ জন্য এই খাতে বিনিয়োগ করেছে বিএসআরএম। কাজুবাদামের মতো খাতের সম্ভাবনা উন্মোচন করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ও উৎসাহ দিয়েছে আমাদের। আমরা শুধু কারখানায় বিনিয়োগ করছি না, কয়েক বছরে দেড় হাজার কৃষককে প্রশিক্ষণও দিয়েছি। কারণ, উৎপাদন বাড়লে বাংলাদেশি কাজুবাদামের ব্র্যান্ড গড়ে তোলা যাবে।’
মোহাম্মদ মনির হোসেন, বিএসআরএম গ্রুপের হেড অব করপোরেট স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড প্রজেক্টস

উৎপাদনে বিএসআরএম ও সিটি

সিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনায় থাকা রহিমা ফুড করপোরেশন কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ করেছে গত বছর। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের উত্তর রূপসী এলাকায় এই কারখানার অবস্থান। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে বলা হয়, যন্ত্রপাতি স্থাপনের পর গত বছরের ২২ মে থেকে বাণিজ্যিকভাবে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে। দেশের পাশাপাশি বিদেশে বাজারজাতের কথা বলা হয় তাতে। পার্বত্য এলাকার কয়েকজন কৃষক জানান, এ বছর পাহাড়ে উৎপাদিত ফলনের সিংহভাগই কিনে নিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান।

ইস্পাত খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি বিএসআরএমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচার প্রোডাক্টস লিমিটেডের চট্টগ্রামের নাছিরাবাদ শিল্প এলাকার কারখানায় কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত শুরু হয় এ বছরের জুন থেকে। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ১০ কেজির প্যাকেটজাত আকারে এই বাদাম বাজারজাত করছে। তাদের ব্র্যান্ডের নাম ‘হিলট্র্যাক্স’। চট্টগ্রামের নাছিরাবাদ শিল্প এলাকায় এই কারখানায় প্রতিদিন এক হাজার কেজি বাদাম উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।

নাছিরাবাদের পাশাপাশি মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরেও নতুন বিনিয়োগ করবে বিএসআরএম। সেখানে জমি বরাদ্দের জন্য গত ২১ জুন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তিও করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় ১০ একর জায়গায় এই কারখানায় বিনিয়োগ হবে ১৫৭ কোটি টাকা। কর্মসংস্থান হবে ৪০০ জনের। দেশীয় বাজারের পাশাপাশি রপ্তানিও লক্ষ্য তাদের।

জানতে চাইলে বিএসআরএম গ্রুপের হেড অব করপোরেট স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড প্রজেক্টস মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, ‘কাজুবাদাম সম্ভাবনাময় খাত। দেশীয় বাজারে চাহিদা বাড়ছে। আবার রপ্তানিতে ভিয়েতনাম ও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা রয়েছে আমাদের। এ জন্য এই খাতে বিনিয়োগ করেছে বিএসআরএম। কাজুবাদামের মতো খাতের সম্ভাবনা উন্মোচন করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ও উৎসাহ দিয়েছে আমাদের। আমরা শুধু কারখানায় বিনিয়োগ করছি না, কয়েক বছরে দেড় হাজার কৃষককে প্রশিক্ষণও দিয়েছি। কারণ, উৎপাদন বাড়লে বাংলাদেশি কাজুবাদামের ব্র্যান্ড গড়ে তোলা যাবে।’

কাজুবাদামে বিনিয়োগে আসছে কাজী ফার্মস গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কাজী বাদাম লিমিটেডও। মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১৮৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে প্রতিষ্ঠানটি। গত ২৮ মে প্রতিষ্ঠানটি বেপজার সঙ্গে চুক্তিও করেছে। এই কারখানায় কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করে তা বিদেশে রপ্তানি করবে প্রতিষ্ঠানটি। বাদামের পাশাপাশি খোসার তেলও উৎপাদন করবে তারা।

এ ছাড়া নরসিংদীতে মাজ্জাক অ্যাগ্রো বিজনেস লিমিটেডও ২০২০ সালে কাজুবাদামের স্বয়ংক্রিয় কারখানা চালু করেছে। পার্বত্য এলাকা থেকে কাঁচা কাজুবাদাম সংগ্রহের পাশাপাশি আমদানি করে প্রক্রিয়াজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আজাদ ইকবাল বলেন, প্রতিদিন দুই টন উৎপাদনক্ষমতার এই কারখানার প্রস্তুত বাদাম এখন দেশে বাজারজাত হচ্ছে। রপ্তানির চেষ্টাও চলছে।

খোসা ছাড়িয়ে যেভাবে বাদাম তৈরি হয়

কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাবার উপযোগী বাদাম তৈরি করা হয়। কাজুগাছে কাজু আপেলের নিচে খোসাসহ বাদাম যুক্ত থাকে। কাজু আপেল থেকে খোসাসহ বাদাম আলাদা করে প্রথমে সূর্যের তাপে শুকিয়ে আর্দ্রতা কমিয়ে আনা হয়। এরপর কারখানায় নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে খোসা ছাড়িয়ে বাদাম আলাদা করা হয়। ধূসর বাদামি রঙের কাঁচা কাজুবাদামের খোসায় রয়েছে উরুশিওল নামের একধরনের জৈব যৌগ। নিয়মিত এই উপাদানের সংস্পর্শে চামড়ায় চুলকানি ও ঘা হয়। এই উপাদান যাতে বাদামের সংস্পর্শে না আসে, সে জন্যই দীর্ঘ প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে যেতে হয় বলে জানালেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।

নাছিরাবাদে বিএসআরএম গ্রুপের বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচার প্রোডাক্টসের কারখানায় গিয়ে গত সপ্তাহে দেখা যায়, প্রথম ধাপে বয়লারে বাষ্পের সাহায্যে খোসাসহ বাদাম সেদ্ধ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপে সেদ্ধ বাদাম ২৪ ঘণ্টা পর স্বয়ংক্রিয় ছাঁকনিতে বড়-ছোট কাজুবাদাম আলাদা করা হয়। তৃতীয় ধাপে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে খোসা থেকে বাদাম আলাদা করা হয়। কাঁচামাল থেকে ৩০ শতাংশ বাদাম পাওয়া যায়। আলাদা করা বাদামের ওপর তখনো ডোরাকাটা হালকা আবরণ।

চতুর্থ ধাপে এই বাদাম ড্রায়ারে রেখে আর্দ্রতা কমানো হয়। পঞ্চম ধাপে বাদামের আবরণ নরম করার জন্য আবারও আর্দ্রতা দেওয়া হয়। ষষ্ঠ ধাপে বিশেষ যন্ত্রে বাতাসের প্রচণ্ড চাপে বাদামের ওপরের ডোরাকাটা আবরণ আলাদা করা হয়। বাদামের আবরণ ছাড়িয়ে নেওয়ার পর সপ্তম ধাপে গোটা ও ভাঙা বাদাম আবারও স্বয়ংক্রিয় ছাঁকনিতে আলাদা করা হয়। প্রস্তুত বাদাম প্যাকেটজাত করার আগে অষ্টম ধাপে আবারও আর্দ্রতা কমানো হয়।

সাদা বাদাম ভাজার যন্ত্রও দেখা যায় কারখানাটিতে। মরিচারোধী ইস্পাতের বড় পাত্রে বাদামের সঙ্গে নানা উপাদান মিশিয়ে শুধু উচ্চতাপে প্রস্তুত বাদাম ভাজা হয়। মান ঠিক রাখতে বাদাম ভাজার সময় কোনো তেল ব্যবহার হয় না। 

কারখানার কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত দেশীয় পাঁচ কেজি খোসাসহ কাজুবাদাম থেকে এক কেজি খাওয়ার উপযোগী বাদাম পাওয়া যায়। আমদানি করা বাদামে অবশ্য সাড়ে চার কেজিতে মেলে এক কেজি খাওয়ার উপযোগী বাদাম।

কারখানায় বিনিয়োগের সুফল কৃষিতে

বড় শিল্প গ্রুপগুলো প্রক্রিয়াজাত কারখানায় বিনিয়োগের পর দেশে কাজুবাদামের ভালো দাম পাচ্ছেন কৃষকেরা। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে খোসাসহ বাদামের দাম বেড়েছে তিন গুণ। যেমন ২০১৯ সালে প্রতি কেজি কাঁচা কাজুবাদামের কৃষক পর্যায়ে দাম ছিল ৪০ টাকা। পরের বছর প্রতি কেজি ৫৫ টাকায় বিক্রি হয় কাজুবাদাম। গত বছর প্রতি কেজি বিক্রি হয় ১০০ টাকা করে। এ বছর প্রতি কেজি ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে খোসাসহ বাদাম। মূলত বাদাম কিনতে কারখানাগুলোর কাড়াকাড়ির কারণে দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে।  

দাম পাওয়ার কারণে প্রতিবছর কাজুবাদামের আবাদ বাড়ছে। কৃষি বিভাগও কাজুবাদামের আবাদ বাড়াতে প্রকল্প হাতে নিয়েছে। জানতে চাইলে ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক শহীদুল ইসলাম বলেন, কাজুবাদাম চাষের এলাকা ও ফলন প্রতিবছর বাড়ছে। এ বছর কাজুবাদামের আবাদ ছয় হাজার হেক্টরে দাঁড়াতে পারে। আবাদ বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।

উৎপাদন বাড়লেও প্রক্রিয়াজাত কারখানাগুলোর চাহিদা বেশি। এ জন্য কাঁচামাল হিসেবে কাঁচা কাজুবাদাম আমদানি করছে বড় কারখানাগুলো। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দীর্ঘ সময় পর কাজুবাদামে শুল্ককরে বৈষম্য নিরসন করায় কাঁচামাল হিসেবে আমদানিতে এখন সমস্যা নেই বলে জানালেন উদ্যোক্তারা।

নীলফামারী জ্যাকপট কেশোনাট ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইবনুল আরিফুজ্জামান বলেন, দেশীয় উৎপাদন না বাড়লে কাজুবাদামের ছোট-মাঝারি কারখানাগুলো সচল রাখা কঠিন। কারণ, সবাই আমদানি করে কাঁচামালের সরবরাহ জোগান দিতে পারছে না। উৎপাদন বাড়লে এ সমস্যা থাকবে না।

ভিয়েতনামের হাতে বাজার, তবে...

২০২২ সালে বিশ্বে প্রস্তুত বাদাম রপ্তানি হয় ৪০৩ কোটি ডলারের। তার মধ্যে ২৬৭ কোটি ডলারের বাদাম রপ্তানি করেছে ভিয়েতনাম। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। তাদের রপ্তানি ৩৫ কোটি ডলারের।

কাজুবাদাম রপ্তানিতে একসময় ভারত ছিল শীর্ষে। তবে ২০০৭ সাল থেকে ভারতকে হটিয়ে শীর্ষ স্থান দখল করে নেয় ভিয়েতনাম। ভারতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়তে থাকায় রপ্তানি কমতে থাকে। সেই থেকে বিশ্ববাজারে ভিয়েতনামের প্রক্রিয়াজাত বাদামই খাচ্ছে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ।

ভিয়েতনাম ক্যাশো অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যে দেখা যায়, ভিয়েতনামের বাদামের মান নিয়ে ক্রেতা দেশগুলোর অভিযোগের তালিকা লম্বা হচ্ছে। মূলত দীর্ঘদিন কাঁচা কাজুবাদাম গুদামজাত রাখার কারণে মান খারাপ হচ্ছে। এরপরও বিকল্প বড় বাজার না থাকায় ভিয়েতনামমুখী হচ্ছেন ক্রেতারা।

কাজুবাদাম প্রকল্পের পরিচালক শহীদুল ইসলাম বলেন, খুব অল্প সময়ে কাজুবাদামের ২২টি ছোট-বড় কারখানা গড় উঠেছে দেশে। যেভাবে আবাদ বাড়ছে ও নতুন নতুন কারখানা হচ্ছে, তাতে সামনে দেশের চাহিদা মিটিয়ে কাজুবাদাম রপ্তানিতে নাম লেখাবে বাংলাদেশ।