গাছগাছালির ব্যবসা চলে ১২ মাস

বাড়ির ছাদে বা বিভিন্ন অফিসে গাছের ব্যবহার বেড়েছে। তাতে নার্সারির ব্যবসাও বড় হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে সড়কের পাশে নার্সারিতে পছন্দের গাছ দেখছেন আগ্রহী ক্রেতারা। সম্প্রতি তোলা ছবি
শুভ্র কান্তি দাশ

বাসাবাড়ির বারান্দা আর ছাদে গাছ লাগানোর পাশাপাশি ঢাকা শহরের অফিস–রেস্তোরাঁয়ও সৌন্দর্যবর্ধনের অন্যতম অনুসঙ্গ এখন নানা জাতের গাছগাছালি। এমনকি কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক–রাজনৈতিক, সরকারিসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানেও নিবিড় শ্যামলশোভা বাড়াতে আয়োজকেরা নার্সারি থেকে গাছগাছালি ভাড়া নিয়ে আসেন। অনুষ্ঠানেকন্দ্রিক সবুজায়নের কাজটি কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে করেন, আবার অনেকেই পেশাদার নকশাকারক ও স্থপতিদের দিয়ে করান।

রাজধানীতে বারো মাস গাছগাছালি বেচাকেনার পাশাপাশি ভাড়া দেওয়া–নেওয়ার ব্যবসাও দিন দিন বাড়ছে। নার্সারির মালিকেরা জানান, বর্তমানে ঢাকা শহর ও আশপাশের এলাকায় ছোট, মাঝারি ও বড় মিলিয়ে প্রায় ৮০০ নার্সারি আছে। এর মধ্যে ছোট আকারের ৪৫০ ও মাঝারি ২৫০টি। বাকিগুলো বড় আকারের। ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় নার্সারি আছে প্রায় ৩০০টি। ঢাকার আগারগাঁও, তিন শ ফুট, এক শ ফুট, দিয়াবাড়ী, দোয়েল চত্বর, বেইলি রোড, কাকরাইল ও বেড়িবাঁধ এলাকায় অধিকাংশ নার্সারি গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কিছু নার্সারি আছে। অন্যদিকে সাভার, আশুলিয়া, রূপগঞ্জ, গাজীপুরসহ ঢাকার আশপাশের এলাকায় আছে প্রায় ৫০০টি নার্সারি। এদিকে নার্সারিকে কেন্দ্র করে গাছ পরিচর্যার বিভিন্ন উপকরণ ও যন্ত্রপাতির ব্যবসাও রয়েছে। সব মিলিয়ে এই খাতে প্রতিবছর কয়েক শ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়।

নার্সারিগুলোর জন্য ঢাকায় কয়েকটি স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন। এতে নার্সারির মালিকেরা ব্যবসার জন্য প্রতিযোগিতাপূর্ণ ভালো পরিবেশ পাবেন। পাশাপাশি এই খাতসংশ্লিষ্ট অন্য ব্যবসায়ীরাও সেখানে পণ্য বিক্রি করতে পারবেন।
মো. মেজবাহ উদ্দিন, সভাপতি, বাংলাদেশ প্ল্যান্ট নার্সারি মেন সোসাইটি।

বছরে আয় আড়াই শ কোটি টাকা

সরেজমিনে ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ছোট আকারের একটি নার্সারিতে দৈনিক গড়ে ৪ হাজার, মাঝারি নার্সারিতে ৮ হাজার ও বড় নার্সারিতে ৩০ হাজার টাকার গাছ বিক্রি হয়। সব মিলিয়ে ঢাকা ও আশাপাশের এলাকার প্রায় ৮০০ নার্সারিতে দৈনিক গড়ে ৬৮ লাখ টাকা ও বছরে প্রায় ২৪৮ কোটি টাকার গাছ কেনাবেচা হয়।

নার্সারির মালিক ও বিক্রয়কর্মীরা জানান, ফলের মধ্যে এখন আমগাছই ক্রেতাদের প্রথম পছন্দ। এ ছাড়া লেবু, কামরাঙা, মাল্টা, কতবেল, পেয়ারা, আমলকী, চেরি, আমড়া, বরই ইত্যাদি ফলের গাছও ভালো বিক্রি হয়। ফুলের মধ্যে গোলাপের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ ক্রেতাদের। সেই সঙ্গে বেলি, জুঁই, জবা, চামেলি, কাঠগোলাপ, হাসনাহেনা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, কসমস, পিটুনিয়া বেশি জনপ্রিয়। আর সবজিজাতীয় ও ভেষজ উদ্ভিদের মধ্যে মরিচ, টমেটো, ঢ্যাঁড়স, লাউ, শিম, পেঁপে, শসা, পুদিনা, তুলসী ও অ্যালোবেরার চাহিদা বেশি। আকারভেদে এসব গাছের দাম ৫০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

এর বাইরে ইনডোর বা ঘরসজ্জার জন্য ক্যাকটাস, অর্কিড, সাকুল্যান্ট, বিভিন্ন বনসাই, পাইকাস, মনস্টেরা, মানিপ্ল্যান্ট, বিভিন্ন প্রজাতির ফার্ন, এরিকা পাম, অগ্নিশ্বর, অ্যাগলোনিমা ইত্যাদির চাহিদা বেশি। আকার ও প্রজাতিভেদে এসব গাছের একেকটির দাম আড়াই শ থেকে এক হাজার টাকা। তবে বনসাই ১৫ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত পড়ে।

নার্সারিগুলো দেশীয় গাছের পাশাপাশি আমদানি করা বিদেশি গাছও বিক্রি করে। আশুলিয়া গার্ডেন সেন্টারের কর্মকর্তা সনি সরকার জানান, তাঁরা প্রতিবছর ভারত, ইতালি ও থাইল্যান্ড থেকে ফল, ফুল ও অর্নামেন্টাল গাছের প্রায় এক লাখ চারা আমদানি করেন।

অনলাইনেও ভালো বিক্রি

অন্য অনেক পণ্যের মতো এখন অনলাইনে গাছগাছালি বেচাকেনারও একটি বড় বাজার গড়ে উঠেছে; যার প্রায় সবটাই ফেসবুকনির্ভর। বর্তমানে ঢাকায় এ রকম প্রায় ২৫টি অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে বলে জানা গেছে। এ রকমই এক প্রতিষ্ঠান অরণীর স্বত্বাধিকারী ইফতেসা অরণী প্রথম আলোকে জানান, অনলাইনে ক্রেতাদের ভালো সাড়া পান তিনি। দিনে মোট ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার সাত–আটটি ক্রয়াদেশ আসে। এ ছাড়া কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানেও গাছ বিক্রি করেন তিনি। সব মিলিয়ে মাসে তিনি সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা আয় করেন।

আরও কয়েকটি অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা প্রতি মাসে গাছ বিক্রির মাধ্যমে গড়ে ৫০ হাজার টাকার বেশি আয় করেন। সেই হিসাবে এসব প্রতিষ্ঠান মাসে সাড়ে ১২ লাখ ও বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার গাছ বিক্রি করে।

গাছ ভাড়া

বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি অফিস সৌন্দর্যবর্ধনে গাছ ভাড়া নেয়। ঢাকা ও আশপাশের এলাকার শতাধিক নার্সারি ও প্রতিষ্ঠান চুক্তির ভিক্তিতে এই ব্যবসা করে। তারা গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে পরিচর্যার পাশাপাশি প্রতি মাসে গাছ প্রতিস্থাপনও করে দেয়।

পল্লবীর গ্রিন ফ্যাক্টরি নার্সারির মালিক আরিফুল আজম জানান, তাঁরা প্রতিটি গাছের ভাড়া নেন ৮০ থেকে ১৫০ টাকা। অফিসগুলো সাধারণত ফিলোডেনড্রন, এরিকা পাম, ড্রাসিনা, পথোস বা মানিপ্ল্যান্ট, অ্যাগলোনিমা, পিস লিলি, লেমন লাইম—এসব গাছ বেশি ভাড়া নেয়।

আরও যত সেবা

অনেকেই এখন অ্যাপার্টমেন্ট ও বড় অফিসের আঙিনা বা দেয়াল বিভিন্ন ধরনের গাছগাছালি ও লতাগুল্ম দিয়ে নান্দনিকভাবে সাজান। তবে তা হয় স্থপতি ও নকশাকারকদের পরিকল্পনায়। কোথায়, কী উচ্চতায় কোন ধরনের গাছ থাকবে, তা ঠিক করে দেন তাঁরা। এ ধরনের কাজকে ল্যান্ডস্কেপিং ও ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং বলা হয়। ঢাকা শহরে অন্তত ১৫টির মতো প্রতিষ্ঠান এই কাজ করে। এ রকমই এক প্রতিষ্ঠান গ্রিন সেভারসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আহসান রনি জানান, বাড়ির ভেতরে–বাইরে প্রাকৃতিক দৃশ্যের পরিকল্পনার পাশাপাশি ছাদবাগান, বারান্দাবাগান, হাইড্রোফনিক্স, ল্যান্ডস্কেপিং ও ভার্টিক্যাল গার্ডেনিংসহ বাগানবিষয়ক সব রকমের সেবা দেন তাঁরা। তিনি বলেন, ঢাকায় ল্যান্ডস্কেপিংয়ের কাজ করে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। ঢাকার বাইরেও বড় বাজেটের কাজ হয়।

ছাদবাগানের বিকাশের ফলে ঢাকায় এখন মালিসেবাও জনপ্রিয় হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক কানন নার্সারি বাগানবিষয়ক বিভিন্ন সেবার পাশাপাশি ছাদবাগান ও মালিসেবা দেয়। এই নার্সারির ব্যবস্থাপক অলক চ্যাটার্জি জানান, ঢাকায় ব্র্যাক কানন নার্সারিসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এ ধরনের সেবা দেয়। ছাদের আকার ও গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে নির্ধারণ করা হয় পারিশ্রমিক।

কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতির ব্যবসা

গাছ পরিচর্যার জন্য অনেক যন্ত্রপাতিসহ বীজ, সার, মাটি ও বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানসহ নানা কৃষি উপকরণের প্রয়োজন হয়। এই খাতের ব্যবসায়ী ও সূচনা অ্যাগ্রোর মালিক সাইদুল আলম জানান, প্রতি মাসে তাঁর প্রায় ৩০ লাখ টাকার কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি বিক্রি হয়। ঢাকায় তাঁর মতো প্রায় অর্ধশত ব্যবসায়ী রয়েছেন।

নার্সারি ব্যবসায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব

সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে নার্সারি ব্যবসায়। এতে গাছের দামও বেড়েছে। রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকার মামণি নার্সারির কর্মী রবিউল ইসলাম জানান, তাঁদের নার্সারিতে প্রতিটি বিদেশি গাছের দাম ৫০ থেকে ২০০ টাকা আর দেশি গাছের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে।

ট্রেড লাইসেন্স নেই অনেকের

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুল হামিদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীর বেশির ভাগ নার্সারি সরকারি জায়গা বা ফুটপাতে ভাসমান অবস্থায় কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ জন্য তাঁদের কোনো ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয় না বা বিধি অনুযায়ী সেই সুযোগও নেই। তবে যাঁদের নিজস্ব বা ভাড়া জায়গায় নার্সারি আছে, তাঁরা ট্রেড লাইসেন্স পেতে পারেন।

স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্র দাবি

নার্সারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঢাকা সিটি করপোরেশেন এলাকায় নিজস্ব জমি বা ইজারা নেওয়া জমিতে নার্সারির সংখ্যা খুব কম। অধিকাংশ নার্সারিই ফুটপাতকেন্দ্রিক। তাঁরা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাঁদা দিয়ে নার্সারি চালান। তবে বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ হন তাঁরা। এই সমস্যা এড়াতে স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানান নার্সারির মালিকেরা।

এ প্রসঙ্গে নার্সারির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ প্ল্যান্ট নার্সারি মেন সোসাইটির সভাপতি সাভারের রাঙ্গাবন নার্সারির মালিক মো. মেজবাহ উদ্দিন বলেন, নার্সারিগুলোর জন্য ঢাকায় কয়েকটি স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন। এতে নার্সারি মালিকেরা প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায়িক পরিবেশ পাবেন। পাশাপাশি এই খাতসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও সেখানে পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে, ক্রেতাদেরও ভোগান্তিও কমবে।