শিল্প গলা টিপে মারা হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের অভিযোগ

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ ৯টি সংগঠনের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে নেতারা অভিযোগ করেন, দেশের অর্থনীতি কীভাবে বাঁচবে, সেটি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।

বিভিন্ন ব্যবসায়িক অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বারের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল। আজ রোববার ঢাকার গুলশান ক্লাবেছবি: বিটিএমএর সৌজন্যে

এক থেকে দেড় মাস ধরে প্রকট গ্যাস-সংকট, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের ঘাটতি, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার, ঋণের কিস্তি পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বেতন-ভাতা না দিলে মালিকদের কারাগারে পাঠানোর হুমকিতে দেশের শিল্পকারখানার মালিকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। 

শিল্পকারখানার মালিকেরা বলছেন, শিল্পবিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিল্পকারখানা গলা টিপে মেরে ফেলা হচ্ছে। চাঁদাবাজি চলছে। দুর্নীতিও শেষ হয়নি। তবে দেশের অর্থনীতি কীভাবে বাঁচবে, সেটি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। নতুন কর্মসংস্থান না হলে কোথায় যাবে এই দেশ—এমন প্রশ্নও করেন তাঁরা। 

শিল্প খাতে জ্বালানি-সংকট নিয়ে গুলশান ক্লাবে গতকাল রোববার যৌথ সংবাদ সম্মেলনে শিল্পকারখানার মালিকেরা এসব কথা বলেন। তাঁরা আরও বলেন, জ্বালানি উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতির পরও শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের সরবরাহ বাড়েনি। তীব্র গ্যাস-সংকটে অনেক শিল্পকারখানার উৎপাদনে ধস নেমেছে। চলতি মূলধন সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এমন পটভূমিতে পবিত্র ঈদুল আজহার আগে কারখানাগুলো শ্রমিকের বেতন-ভাতা দিতে পারবে, এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর আয়োজনে এই যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সহযোগী হিসেবে ছিল দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই), ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ (আইসিসিবি), বাংলাদেশ টেরিটাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিটিএলএমইএ), চামড়াজাত পণ্য ও জুতা উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতি (এলএফএমইএবি) এবং প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিপিজিএমইএ)। যদিও একাধিক সংগঠনের কোনো প্রতিনিধি সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। 

সংবাদ সম্মেলনে বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা জাতির জন্য অনেক বড় ক্ষতি। আজকে ২০২৫ সালে শুধু শিল্প না, শিল্পোদ্যোক্তাদেরও মেরে ফেলা হচ্ছে। এটাকে একরকম ষড়যন্ত্র মনে করি আমি। ...অস্ট্রিচ পাখি (উটপাখি) বিপদ আসলে বালুর মধ্যে মাথায় লুকায়। আমাদের উপদেষ্টারা অস্ট্রিচ পাখির মতো হয়ে গেছে। মনে হয় তাঁরা কিছু দেখতে পারছেন না। প্রতিনিয়ত কারখানা বন্ধ হচ্ছে। কিছুদিন পর মানুষ রাস্তায় নামবে। আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে।’    

বিটিএমএর সভাপতি আরও বলেন, ‘বড় বড় গল্প শুনি, বিডা নাকি বিদেশি বিনিয়োগকারী নিয়ে আসবে। একজন শিল্পপতিকে নিয়ে আসেন না আমাদের সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসা করুক। গত আট মাসে আটটা কেন, একটাও তো আসেনি। বাংলাদেশে ব্যবসার খরচ অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। আমরা একটা অস্বস্তিকর পরিবেশে আছি।

বিসিআইয়ের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘সরকার থেকে ধমক দেওয়া হচ্ছে, নির্ধারিত সময়ে বেতন-ভাতা না দিলে মালিকদের জেলে দেবে। অথচ ওনারা গ্যাস দেবেন না; ব্যাংকের সুদহার বাড়াবেন। আবার আমাকে গ্যাসের বিল দিতে হবে; ব্যাংকের ঋণ দিতে হবে। কোথা থেকে দেব। ...সরকার যদি প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখতে না পারে তাহলে শিল্পমালিকেরা দায়ভার কেন নেবেন।’ তিনি বলেন, দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের জেগে ওঠা উচিত।

গ্যাস-সংকটে টেরিটাওয়েল খাতের বড় পাঁচ-ছয়টি এবং হোম টেক্সটাইলে কয়েকটি বড় কারখানা বন্ধ হয়েছে এমন তথ্য দিয়ে বিটিটিএলএমইএ চেয়ারম্যান হোসেন মেহমুদ বলেন, গত জানুয়ারি থেকে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট চলছে। স্থানীয় শিল্প কীভাবে টিকবে, তার দিকে বেশি নজর দেওয়া দরকার। 

বিটিএমএর পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমরা সমুদ্র বিজয় নিয়ে অনেক আনন্দ-ফুর্তি করেছি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো গ্যাস উত্তোলন করতে পারি নাই। পার্শ্ববর্তী দেশ ঠিকই গ্যাস উত্তোলন করছে।

বস্ত্র খাতের ৫০ শতাংশ কারখানা বর্তমানে গ্যাস-সংকটের কারণে বন্ধ বলে উল্লেখ করেন বিটিএমএর সহসভাপতি সালেউদ জামান খান। তিনি বলেন, ‘আমার কারখানা চালানোর মতো গ্যাস না পেলেও প্রতি মাসে ১০ কোটি টাকা বিল দিতে হচ্ছে। বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিকল্প হিসেবে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ দিয়েছি। অথচ সাত ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি হলে শিল্প কীভাবে টিকবে।’ 

সংবাদ সম্মেলন থেকে শিল্পমালিকেরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিল্পে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি করেন। এ ছাড়া ভোলার গ্যাস দ্রুত জাতীয় গ্রিডে আনা, নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত স্থগিত, শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহে মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের আহ্বান জানান তাঁরা।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন বিটিটিএলএমইএর সাবেক চেয়ারম্যান এম শাহাদাত হোসেন, বিটিএমএর পরিচালক রাজীব হায়দার, আবদুল্লাহ আল মামুন, এফবিসিসিআইয়ের সাধারণ পরিষদের সদস্য জাকির হোসেন প্রমুখ।