গুদামে জমছে পণ্য, দুশ্চিন্তাও বাড়ছে

অনেক কারখানাই নগদ অর্থের সংকটে পড়ছে। কেউ কেউ শ্রমিকের বেতন-ভাতা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। 

চট্টগ্রামের চান্দগাঁও শিল্প এলাকায় চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানির জন্য এক যুগ আগে গড়ে ওঠে ম্যাফ সুজ কারখানা। আড়াই কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটি চপ্পল, কেডস, স্নিকারসহ বিভিন্ন ধরনের জুতা তৈরি করে। বর্তমানে তাদের গুদামে পড়ে আছে ১৫০ কোটি টাকার জুতা। ক্রেতারা জাহাজীকরণ পিছিয়ে দেওয়ায় এসব জুতা রপ্তানি করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।

ম্যাফ সুজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাসনাত মোহাম্মদ আবু ওবায়দা প্রথম আলোকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপের দেশগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যের বেচাকেনা কমে গেছে। সে কারণে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত হওয়া জুতার জাহাজীকরণ পিছিয়ে দিয়েছে। তাতে গুদামে তৈরি পণ্যের স্তূপ জমেছে। কাঁচামালেরও স্তূপ জমছে।

বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ম্যাফ সুজের মতো দেশের অনেক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশের পণ্য রপ্তানি পিছিয়ে দিয়েছে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এতে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুদামে প্রস্তুত পণ্যের স্তূপ জমেছে।

জাহাজীকরণ পিছিয়ে যাওয়ায় কারখানায় রপ্তানি পণ্যের মজুত বাড়ছে। মার্চের আগে এই সমস্যা কাটবে বলে মনে হয় না।
এস এম আবু তৈয়ব, এমডি, ইনডিপেনডেন্ট অ্যাপারেলস

একাধিক খাতের রপ্তানিকারকেরা বলছেন, অনেক কারখানা এখন নগদ অর্থের সংকটে পড়েছে। কেউ কেউ শ্রমিকের বেতন-ভাতা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। তা ছাড়া কাঁচামালের অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না অনেকে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সুবিধা নেওয়াও অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে।

পণ্য রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে। এ কারণে পণ্য জাহাজীকরণ পিছিয়ে যাওয়া, অর্থ বিলম্বে পরিশোধ ও নতুন ক্রয়াদেশ আসার গতি শ্লথ হওয়ার প্রভাব স্বাভাবিকভাবে পোশাকশিল্পেই বেশি।

চট্টগ্রামের ইনডিপেন্ডেন্ট অ্যাপারেলসের দুই লাখ ডলারের একটি চালান যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়ার কথা চলতি মাসে। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে চালানের পণ্য তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি জানিয়ে দেয়, তারা আগামী জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে তিন কিস্তিতে পণ্য নেবে।

জানতে চাইলে ইনডিপেনডেন্ট অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এস এম আবু তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজীকরণ পিছিয়ে যাওয়ায় কারখানায় রপ্তানি পণ্যের মজুত বাড়ছে। মার্চের আগে এই সমস্যা কাটবে বলে মনে হয় না।

দুই–তিনটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পণ্য জাহাজীকরণ পিছিয়ে দেওয়ায় নারায়ণগঞ্জের এমবি নিটওয়্যার কারখানার গুদামে তিন-চার মাস ধরে ১২ লাখ ৬৭ হাজার ডলারের তৈরি পোশাক পড়ে আছে। এ ছাড়া সাড়ে ছয় লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হলেও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান অর্থ ছাড় করছে না।

আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, সমস্যাগুলো সাময়িক।ব্যবসায়ীরা এসব সমস্যা যাতে উতরাতে পারেন, সে জন্য ব্যাংক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক

এমবি নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আমাদের মতো অনেক পোশাক কারখানার গুদামেই প্রস্তুত পণ্যের পাহাড় জমেছে। এতে কারখানাগুলো নানা রকম সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ‘এলপিপি পোল্যান্ড’ নামের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তাদের শতাধিক সরবরাহকারীকে পণ্য জাহাজীকরণে বিলম্ব করতে বলে। এতে প্রায় ছয় কোটি ডলারের তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুদামে জমে যায়।

 বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠানই মজুত পণ্য নিয়ে বিপদে আছে। আশা করছি, ডিসেম্বরের পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’

বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের দুই লাখ ডলারের প্রস্তুত পণ্যের জাহাজীকরণ পিছিয়ে দিয়েছে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। আবার দেড় লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানির পর অর্থ পরিশোধে দুই মাস সময় দাবি করেছে আরেকটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ক্রিয়েশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, মজুত পণ্যের চেয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া। এরই মধ্যে ক্রয়াদেশ ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমেছে। ২০২৩ সালও এমনটা যেতে পারে বলে অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পূর্বাভাস দিচ্ছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথমআলোকে বলেন, আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, সমস্যাগুলো সাময়িক।ব্যবসায়ীরা এসব সমস্যা যাতে উতরাতে পারেন, সে জন্য ব্যাংক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।অন্যদিকে ব্যবসায়ীদেরও উচিত, ক্রয়াদেশ অনুযায়ী উৎপাদন পরিকল্পনার লক্ষ্য পুনর্নির্ধারণ করা।যাতে নতুন করে পণ্যের মজুত না জমে।আবার বাড়তি মূলধন নেওয়ার প্রয়োজনও খুব বেশি না হয়।